ফাল্গুন – চৈত্রে
- ১) এই সময় থেকে গরম পড়তে আরম্ভ করে। গ্রীষ্মকাল শুরু হয়। তার পরেই বর্ষা নামে। প্রণোদিত প্রজননের মাধ্যমে এর পর থেকে চাষযোগ্য মাছের ডিম পোনা পাওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া ছোট ছোট পুকুর ইত্যাদিতে এখন জল অনেক কমে যায়। কাজেই আঁতুড় পুকুর প্রস্তুতি শুরু করার এটাই কিন্তু উপযুক্ত সময়। এই সময় জঙ্গল পরিষ্কার, পাড় বাঁধাই ইত্যাদি কাজ সেরে রাখলে প্রথম ফসলটি তোলা সহজ হবে।
- ২) যাঁরা প্রণোদিত প্রজননের জন্য উপযুক্ত মাছ নিয়মমতো আগেই সংগ্রহ করেছেন, এখনই কিন্তু তাদের আরও ভালো ভাবে পরিচর্যা হওয়া দরকার। এই সময়েই তারা বাড়বে। বেশি উপযুক্ত খাবার পেলে উন্নতি হবে খুব তাড়াতাড়ি। রোজ নিয়মিত খাবার দিতে হবে, মাঝে মাঝে জাল টানতে হবে, মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। জাল টানার পর পটাশ পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণে স্নান করিয়ে দিতে হবে। হ্যাঁ পুকুরের জলের গভীরতা যেন ঠিক থাকে। জল কমে গেলে নতুন জল প্রবেশ করিয়ে গভীরতা ঠিক রাখা দরকার। আর একটা কথা, পিটুইটারি গ্রন্থি সংগ্রহ করতে হবে এই সময়। পূর্ণবয়স্ক, টাটকা মাছ থেকে এগুলো সংগ্রহ করা প্রয়োজন। ব্রিডিং, পুল, হ্যাচিং পুল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা দরকার। জলের লাইন সব ঠিক আছে কি না দেখে নিয়ে এই সময়েই সব কিছু ঠিক করতে হবে। এর পরেই কিন্তু ব্রিডিং সেট বসানো যাবে। তবে এই সময় স্ত্রী মাছগুলোকে প্রতি কেজি ওজন হিসাবে ১ – ২ মিগ্রা পিটুইটারি হরমোনের দ্রবণ ইনজেকশন দিলে ডিম্বাণুর উন্নতি ত্বরান্বিত হবে।
- ৩) যে সমস্ত পুকুরে নিবিড় মিশ্র মাছ চাষ চলছে, সেখানে নিয়মিত খাবার ও সার প্রয়োগ করতে হবে। মাঝে মাঝে জাল টেনে, মাছদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এর পরের ২/৩ মাসেই কিন্তু মাছ সব চেয়ে বেশি বাড়ে। কাজেই পরিচর্যা ভালো করা প্রয়োজন। দরকার হলে মাছের বাড়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। এই সময় প্রতিষেধক হিসাবে চুনের মাসিক কিস্তি প্রয়োগ দরকার। জলের মাত্রা ঠিক না থাকলে মাছের বাড় কিন্তু ব্যাহত হবে।
- ৪) যে সমস্ত চাষিভাই নতুন করে নিবিড় মিশ্র মাছ চাষ শুরু করতে চান তাঁদের কিন্তু পুকুর সংস্কারের কাজ, যেমন মাটি কাটা, জঙ্গল পরিষ্কার করা, সঠিক ঢাল রেখে পুকুরের পাড় বাঁধাই ইত্যাদি এখনই করে ফেলতে হবে।
- ৫) যাঁরা নোনা জলের মাছ ও চিংড়ি চাষের জন্য নিয়মমতো পুকুর/জলা তৈরি করেছেন, তাঁরা একই বীজ সংগ্রহের জন্য তৎপর হোন। এই সময় থেকেই বাগদা ইত্যাদি নোনা মাছের বীজের গলন শুরু হবে। যে সব ভাই নোনা জলের চিংড়ি ও মাছের বীজ সংগ্রহ করার কাজ করেন তাঁদের একটা কথা মনে রাখা দরকার — বাগদার মীন সংগ্রহ করতে গিয়ে অন্যান্য মাছের ও চিংড়ির বীজ কোনও মতেই ডাঙায় ফেলে নষ্ট করবেন না। এটা অন্যায়। তাদের জ্যান্ত অবস্থায় আবার জলে ফিরিয়ে দিয়ে বাঁচার সুযোগ করে দিন।
- ৬) যাঁরা ব্যবহৃত আঁতুড় পুকুরে জিওল মাছের চাষ করেছেন, এখনই সেগুলো ধরার বন্দোবস্ত করুন। না হলে ডিম পোনা চাষের সুযোগ কমে যাবে। মাগুর মাছের প্রণোদিত প্রজনন যাঁরা করতে চান তাঁরা এই সময়েই সুস্থ, সবল পূর্ণ বয়স্ক মাছ আলাদা করে মজুত করুন।
চৈত্র – বৈশাখে
- ১) আঁতুড় পুকুর, যাতে ডিমপোনা চাষ করা হবে — তার জঙ্গল সাফাই ও পাড় বাঁধাই করা প্রয়োজন। না হলে আর দেরি না করাই ভাল। যে সমস্ত আঁতুড় পুকুরে জল নেই তাতে বিঘা প্রতি ২ – ৫ কেজি ধনচে বীজ ছড়িয়ে দিতে হবে এবং ৩০ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে। আর জল থাকলে বিঘাপ্রতি প্রতি ফুট জলের জন্য ১০০ কেজি হারে মহুয়া খৈল প্রয়োগ করতে হবে। দিন পনেরো পর ধনচে চাষ করা পুকুরে লাঙল দিয়ে ধনচে চারা মাটিতে মিশিয়ে জল ঢুকোতে হবে।
- ২) প্রণোদিত প্রজননের জন্য আলাদা করে রাখা মাছগুলোর নিয়মমাফিক পরিচর্যা এই সময় চালিয়ে যেতে হবে। যে সমস্ত মাছের আগেই সার্বিক উন্নতি বিধানের জন্য পিটুইটারি গ্রন্থি ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল সেগুলোকে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে প্রজননের উপযুক্ত হয়েছি কি না। কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে। এ মাসের শেষের দিকে ঠান্ডা দিন দেখে তাদের প্রজননের জন্যে বসাতে হবে। প্রথমে স্ত্রী মাছকে প্রতি কেজি ওজনের জন্য ২ – ৩ মিগ্রা গ্রন্থির নির্যাস ইনজেকশন দিতে হবে। যদি আবহাওয়া সব দিক থেকে অনুকূল থাকে তবে প্রথম ইনজেকশন দিতে হবে বিকেল ৪ টে নাগাদ। ৬ ঘণ্টা পর দ্বিতীয় ইনজেকশন দেওয়া দরকার। স্ত্রী মাছকে কেজি প্রতি ওজনে ৫ – ৮ মিগ্রা এবং উপযুক্ত সংখ্যক পুরুষ মাছকে এই সময় প্রতি কেজি ওজনে ২ – ৩ মিগ্রা হারে পিটুইটারি গ্রন্থির নির্যাস ইনজেকশন দিয়ে পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে একই সঙ্গে ব্রিডিং পুলে ছেড়ে দিতে হবে। পরের দিন নিষিক্ত ডিমগুলোকে হ্যাচিং পুলে ছেড়ে ব্রুড ফিশগুলোকে পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের দ্রবণে স্নান করিয়ে আলাদা পুকুরে রাখতে হবে।
- ৩) নিবিড় মিশ্র চাষের পুকুরে নিয়মিত মাছের পরিচর্যা চালাতে হবে। জলের মাত্রা ঠিক রেখে প্রয়োজনমতো মাসিক কিস্তির সার ও চুন এই সময় প্রয়োগ করতে হবে। এখন গরম কাল, পুকুরে ক্রমশই জল কমবে। মাছেদের কিন্তু এ সময়ে রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা। তাই প্রয়োজনে খাবারের সাথে ১০০ মিগ্রা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ মিশিয়ে দিতে হবে।
- ৪) নতুন করে মাছ চাষ শুরু করা হবে এমন পুকুরে সংস্কারের প্রাথমিক কাজের পর বিঘাপ্রতি ১০০ কেজি প্রতি ফুট জলের গভীরতার জন্য জলে মহুয়া খৈল এবং সাত দিন পরে বিঘাপ্রতি ৩০ – ৪০ কেজি চুন দিতে হবে।
- ৫) নোনা জলের চাষিভাইরা তাঁদের প্রস্তুত করা পুকুর এবং জলাশয়ে চিংড়ি এবং মাছের বীজ মজুত অবশ্যই শেষ করবেন। যাঁরা কেবল চিংড়ি চাষ করবেন তাঁরা বিঘাপ্রতি ৬ – ৮ হাজার ৪ – ৬ সেমি সাইজের চিংড়ির বীজ মজুত করবেন। যাঁরা চিংড়ি এবং মাছের মিশ্র চাষ করছেন তাঁরা ৩ – ৫ হাজার/বিঘাপ্রতি চিংড়ির বীজ এবং ৫ – ৬ হাজার মাছের চারা মজুত করবেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাছ মজুত করা মানেই বেশি লাভ নয়, আখেরে লোকসানই। সুযোগ থাকলে মাছ মজুত করার পরে প্রতি দিন শতকরা ১০ ভাগ জল পালটে নিতে পারলে ভালো হয়। গনের সময় (কোটাল) যত খানি সম্ভব জল পালটাতে হবে।
- ৬) লালন পুকুর প্রস্তুতির কাজ এখনই শুরু করতে হবে। পাড় বাঁধাই ও জল পরিষ্কার করতে হবে। প্রতি ফুট জলের জন্য বিঘাপ্রতি ১০০ কেজি হারে মহুয়া খৈল ভালো করে ছড়িয়ে দিতে হবে। এর পর বিঘাপ্রতি ৩০ – ৪০ কেজি চুন প্রয়োগ প্রয়োজন।
বৈশাখ – জ্যৈষ্ঠে
১) যে সমস্ত আঁতুড় পুকুরে মহুয়া খৈল প্রয়োগ করা হয়েছিল বা ধনচের চারা মাটিতে মিশিয়ে জল ঢোকানো হয়েছিল, সেগুলো ডিমপোনা ছাড়ার উপযুক্ত হয়ে যাবে। সেগুলো ভালো করে জাল টেনে পরিষ্কার করে সাবান তেল অথবা কেরোসিন তেল দিয়ে পোকামাকড় মেরে ফেলতে হবে। বিঘাপ্রতি ২.৫ কেজি সাবান ও ৭.৫ লিটার উদ্ভিজ তেল ঈষদোষ্ণ জলে ভালো করে মিশ্রণ তৈরি অথবা বিঘাপ্রতি ২৫ লিটার কেরোসিন তেল (যথা সম্ভব হাওয়া ও বৃষ্টিপাতহীন সময়ে অথবা হাওয়ার অনুকূলে) পুকুরে ভালো করে ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে ক্ষতিকারক পোকামাকড় মারা যাবে। এই কাজটি ডিমপোনা ছাড়ার ১২ – ১৪ ঘণ্টা আগে করতে হবে। মাসের শেষের দিকে প্রজননের পর যে ডিম পাওয়া গেছে তার থেকে বিঘাপ্রতি ৫ – ৮ লাখ হারে ৩ – ৪ দিন বয়সের ডিমপোনা পুকুরে মজুত রাখতে হবে। মজুত করার আগে অবশ্যই ওই পুকুরের জলের সঙ্গে ডিমপোনাগুলোকে সইয়ে নিতে হবে। আঁতুড় পুকুরে ডিমপোনা ছাড়ার আগে ওই পুকুরের প্রাকৃতিক খাবারের পরিমাণ নির্ধারণ সাপেক্ষে মজুতের হার ঠিক করে নেওয়া ভালো। পুকুরের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা ৫০ লিটার জল প্ল্যাঙ্কটন-নেট দিয়ে ছেঁকে নেওয়ার পর প্রাকৃতিক খাবারের পরিমাণ অনুযায়ী বিঘা প্রতি ডিমপোনা ছাড়ার হিসাব :
১ – ২ মিলি হলে
|
২ – ৪ লক্ষ ডিমপোনা বিঘাপ্রতি
|
২ – ৩ মিলি হলে
|
৪ – ৭ লক্ষ ডিমপোনা বিঘাপ্রতি
|
এর আগে মহুয়া খৈল প্রয়োগ করা পুকুরে ভালো করে জাল টেনে ঘেঁটে দিতে হবে। পর্যাপ্ত জল (কমপক্ষে ৩ – ৪ ফুট) প্রয়োগের পর পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্য কেমন হয়েছে দেখতে হবে। প্রতি ৫০ লিটার জলে অন্তত ২ মিলি খাবার হলে ভালো হয়।
এ বার গত বছরের চারাপোনা (৪’’ – ৬’’ সাইজ) বিঘাপ্রতি ১০০টি ভালো ভাবে পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট জলে স্নান করিয়ে শোধন করে ছাড়তে হবে। বিভিন্ন প্রজাতির অনুপাত এই রকম হতে পারে ---
তিন প্রজাতি
|
ছয় প্রজাতি
|
কাতলা
|
৪
|
কাতলা
|
১.৫
|
গ্রাসকার্প
|
১
|
রুই
|
৩
|
সিলভার কার্প
|
২.৫
|
কমন কার্প
|
২
|
মৃগেল
|
৩
|
রুই
|
২
|
মৃগেল
|
১
|
চারাপোনা মজুত করার পর থেকেই কিন্তু তাদের পরিপূরক খাদ্য খাওয়াতে হবে। এর হার নিম্নরূপ হতে পারে
সরষের খোল : চালের কুঁড়ো (১ : ১ )
জ্যৈষ্ঠ – আষাঢ়ে
- ১) আঁতুড় পুকুরে মজুত ডিমপোনার পরিচর্যা করতে হবে। আর যে সমস্ত পুকুর এখনও তৈরি হয়নি দেরি না করে তা এখনই করতে হবে। যেগুলো ইতিমধ্যে ডিমপোনা মজুত করার মতো উপযুক্ত হয়েছে তাতে ডিমপোনা সঠিক মাত্রায় মজুত করা দরকার।
- ২) বর্ষার বৃষ্টি ভালো মতো শুরু হলে প্রণোদিত প্রজনন করতে হবে। সঠিক নিয়ম অনুযায়ী প্রণোদিত প্রজনন করতে হবে।
- ৩) যে সমস্ত পুকুরে নিবিড় মিশ্র মাছ চাষ চলছে তাতে মাছের বাড়বাড়ন্ত অব্যাহত রাখতে নিয়মিত সার, চুন, পরিপূরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে।
- ৪) যে সমস্ত পুকুরে নতুন করে মিশ্র মাছ চাষ শুরু হবে তার জঞ্জাল সাফ, পাঁক তোলা, পাড় সংস্কার, মহুয়ার খৈল, চুন ও গোবর সার প্রয়োগ (প্রথম বার ২০০০ কেজি/হেক্টর বা ২৫০ – ৩০০ কেজি/বিঘা) ইত্যাদি কাজ এ মাসের মধ্যেই করা দরকার।
- ৫) লালন পুকুরে ধানিপোনার পরিচর্যা নিয়মমাফিক চলবে।
- ৬) এই সময় বৃষ্টির জন্য জলের গভীরতা বাড়বে ও নোনা ভাব কমতে থাকবে। চিংড়ির বাড় আস্তে আস্তে কমতে থাকবে। এখন থেকেই পরিচর্যার সাথে সাথে উপযুক্ত মাছ ও চিংড়ি বিক্রি করার ব্যবস্থা করতে হবে নোনা জলের চাষিদের।
- ৭) যাঁরা গলদা চিংড়ি চাষ করতে ইচ্ছুক তাঁরা উপযুক্ত পুকুর বেছে নিয়ে অর্থাৎ যে সব ছোট পুকুরে পাঁক কম বালির ভাগ বেশি এবং এখনও এক দেড় ফুটের বেশি জল হয়নি, সে পুকুরগুলি গলদা চিংড়ির আঁতুড় পুকুরের জন্য তৈরি করুন। জঞ্জাল পরিষ্কার, প্রয়োজন হলে কিছু পাঁক তোলা, পাড় বাঁধাই ইত্যাদি প্রাথমিক কাজ শেষ করে বিঘাপ্রতি প্রতি ফুট জলের জন্য ৪০ – ৫০ কেজি চুন দিন। অথবা জল থাকা অবস্থাতেই বিঘাপ্রতি ৬ – ৮ কেজি ইউরিয়া ও সিঙ্গল সুপার ফসফেট প্রয়োগ করে ভালো করে মিশিয়ে দিন। এই অবস্থায় ১৫ – ২০ দিন থাকলেই পুকুরের তলদেশে নরম শৈবাল জাতীয় চিংড়ির খাবার তৈরি হয়ে যাবে। এই অবস্থাতে ৩ – ৪ ফুট জল হয়ে গেলে পুকুরে গলদা চিংড়ির বাচ্চা (১ – ২ সেমি) বিঘাপ্রতি ১২ – ১৫ হাজার হারে মজুত করে দিন। এই বাচ্চাগুলিকে ১ – ২ মাস এখানে প্রতিপালন করতে হবে। এই পুকুরে বাচ্চাগুলি যাতে খোলস ছাড়ার সময়ে আশ্রয় নিতে পারে তার জন্য বিঘাপ্রতি ২০ – ৩০টি আস্ত তালপাতা বিভিন্ন জায়গাতে ফেলে রাখবেন। প্রতি দিন নিম্নলিখিত হারে ২ বার খাবার দেবেন। জল পরিবর্তন করার সুবিধা থাকলে সপ্তাহে অন্তত ১ বার জল পরিবর্তন করবেন। এ ছাড়া মাসিক কিস্তিতে সারও প্রয়োগ করবেন।
খাবার
চাষ সপ্তাহ
|
দেহের ওজনের শতকরা ভাগ
|
৩ – ৬
|
২০
|
৭ – ১০
|
১৫
|
১১ – ১৪
|
১০
|
১৫ – ১৮
|
৫
|
১৯ – ২০
|
২.৫
|
সার
সার
|
বিঘা প্রতি মাসিক কিস্তি
|
গোবর
|
১২৫ – ১৩৫ কেজি
|
বা
|
|
( পচানো ) মুরগির মল
|
৩০ – ৪০ কেজি
|
সিঙ্গল সুপার ফসফেট
|
৬ – ৮ কেজি
|
আষাঢ় – শ্রাবণে
- ১) আগের মাসে যে সমস্ত আঁতুড় পুকুরের প্রস্তুতি শেষ করেছেন তাতে নিয়মমাফিক ডিমপোনা মজুত করুন ও পরিচর্যা করুন। আগেই যেখানে মজুত আছে বা বিক্রয়যোগ্য হয়ে থাকলে বিক্রি করে দিন। অথবা যথাযথ ভাবে তৈরি করা লালন পুকুরে আগের হিসাব মতো মজুত করুন।
- ২) প্রণোদিত প্রজনন এ মাসেও সম্ভব। মাছ যদি থেকে থাকে তবে চেষ্টা করতে পারেন।
- ৩) আগেই যে সমস্ত লালন পুকুরে ধানিপোনা মজুত হয়েছে বা এ মাসে করবেন, নিয়মমাফিক তার পরিচর্যা করুন। জাল টেনে মজুত পোনাদের স্বাস্থ্য ও বাড় পরীক্ষা করা দরকার।
- ৪) নতুন জল পেয়ে মজুত পুকুরে মাছ কিন্তু এখন বাড়বে ভালো। তাদের ঠিকমতো যত্ন নিতে হবে। নিয়মমাফিক খাবার ও সার প্রয়োগ করা দরকার। যে মাছগুলো বিক্রি করার মতো হয়েছে এবং এখন দাম ভালো পাওয়া যাবে, সেগুলো বিক্রি করা যেতে পারে।
- ৫) নতুন করে যে সমস্ত পুকুরে নিবিড় মিশ্র মাছ চাষ হবে, আশা করি তার প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। এ বারে সঠিক সংখ্যায় ও উন্নত মানের চারাপোনা জোগাড় করুন।
- ৬) যে সমস্ত এলাকায় লবণের ভাটি আছে তার পুকুরের জলের লবণের মাত্রা এখন কমের দিকে। এখানে কিন্তু চিংড়ি চাষ করা সম্ভব!
শ্রাবণ – ভাদ্রে
- ১) ডিমপোনার পুকুরের চাষ প্রায় শেষ। সমস্ত ধানিপোনা ধরে নিয়ে লালন পুকুরে ছাড়তে হবে। অতিরিক্ত বাজারে বিক্রি করা যাবে।
- ২) লালন পুকুরে এখনও কিছু যদি মজুত করা বাকি থাকে তবে তা এখনই করুন এবং নিয়মমাফিক পরিচর্যা করুন। আগেই মজুত করা পুকুরের যে সমস্ত ধানপোনা চারাপোনাতে পরিণত হয়েছে তাদের মজুত পুকুরে স্থানান্তরিত করুন।
- ৩) নিবিড় মিশ্র মাছ চাষের পুকুরে সঠিক ভাবে চারাপোনা মজুত করুন এবং নিয়মমাফিক খাবার ও সার প্রয়োগ করুন।
- ৪) গত বছর যে সমস্ত পুকুরে নিবিড় মিশ্র মাছ চাষ করেছেন আশা করি তাদের বাড় ভালো হয়েছে। নিয়মিত মাছ বাজারজাত করতে থাকুন। ভালো দাম পাবেন।
- ৫) যে সমস্ত আঁতুড় পুকুরে দ্বিতীয় বার ফসল তোলা হয়ে গেছে তাতে এর পরে আর ডিমপোনা চাষ করার সুযোগ নেই। অথচ এই সব ছোট ছোট পুকুরগুলিতে আরও ৬/৭ মাস জল থাকবে। এই জলাশয়গুলিতে কিন্তু খব সহজেই স্বল্পকালীন মাগুর মাছের চাষ করা যেতে পারে। আর যে সমস্ত ডোবা বর্ষার জলে ভর্তি হয়েছে এবং ডিমপোনা চাষের জন্য ব্যবহৃত হয়নি সেগুলিও কিন্তু মাগুর চাষের জন্য ব্যবহার করতে পারেন। স্বল্প সময়ে অতিরিক্ত একটি ভালো ফসলের সঙ্গে ভালো আয়ও পাবেন। দেরি না করে শুরু করে দিন। মাগুরের বাচ্চা এই সময়ে ভালোই পাওয়া যায়।
ভাদ্র – আশ্বিনে
এই সময় মাছ চাষিদের নতুন করে কিছু শুরু করার নেই। যে সমস্ত চাষ চলছে সেগুলো নিয়মমাফিক পরিচর্যা চালিয়ে যেতে হবে। কোনও যেন ত্রুটি না হয়। বিশেষ ভাবে মনে রাখতে হবে যে এখন থেকেই মাছেরা ঠান্ডাতে কাবু হতে থাকবে। বাড় কমে যাবে। এ ছাড়া নানান কারণে এই সময় দুর্বলতার জন্য পরবর্তী কালে মাছেরা/চিংড়িরা নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তাই পুকুরে নিয়মিত চুন প্রয়োগ করা, অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করার সাথে সাথে জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষার দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
আশ্বিন – কার্তিকে
বিশেষ যত্ন নিয়ে সমস্ত চাষের পরিচর্যা চালিয়ে যেতে হবে। সামনের বছরের প্রণোদিত প্রজননের জন্য পরিণত মাছ (ব্রুড ফিশ) এখনই সংগ্রহ করা শুরু করে দিন। এই কারণে ব্রুড ফিশ মজুত করায় পুকুরের প্রস্তুতি নিয়মানুসারে শেষ করতে হবে এবং সুস্থ সবল পুরুষ ও স্ত্রী মাছ সংগ্রহ করে মজুত করার পর তাদের নিয়মমাফিক পরিচর্যা চালিয়ে যেতে হবে। মজুত মাছের মোট ওজনের ৩ – ৫ শতাংশ হারে বাদাম বা সরষের খৈল, চালের কুঁড়ো সমহারে মিশিয়ে মাছকে খেতে দেওয়া ছাড়া মাসে মাসে জাল টেনে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সাথে চুন প্রয়োগ (বিঘা প্রতি ৭ – ১০ কেজি) করা দরকার।
কার্তিক - অগ্রহায়ণে
সমস্ত মজুত মাছের/চিংড়ির পরিচর্যা করা, উপযুক্ত মাছ/চিংড়ি বিক্রয় করা, মেজর কার্পের ব্রুড ফিশ সংগ্রহ ও তার পরিচর্যা করা ঠিকমতো চালিয়ে যাওয়াই এই সময়ের কাজ। যারা সাইপ্রিনাস মাছের প্রজনন করাতে চান তাঁরা ব্রুড ফিশ সংগ্রহ করে পুরুষ ও স্ত্রী আলাদা ভাবে মজুত করুন। এই মাছের আঁতুড় পুকুর প্রস্তুতিও শুরু করা দরকার এই সময়।
নোনা জলের চিংড়ি চাষিরা তৎপর হোন। ধান কাটা হয়ে গেলে বাঁধ ইত্যাদি মেরামত করে স্লুইস গেট ইত্যাদি বসিয়ে দিন। জমি ভালো করে শুকিয়ে ফেলুন।
অগ্রহায়ণ – পৌষে
জলাশয়ের জল কমতে থাকে। মেজর কার্পের ব্রুড ফিশের পুকুরে নিয়মিত জাল, চুন ও সার সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করুন। প্রয়োজনে পুকুরে জল প্রয়োগ অত্যাবশ্যক।
পৌষ – মাঘে
সমস্ত চাষের পুকুরে পরিচর্যা ঠিকমতো করুন। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই কিন্তু বর্ষা নামবে, তখন অনেক কাজ। তাই চাষের নিয়মানুযায়ী যিনি যে রকম মাছের চাষ করবেন সেই অনুসারে সমস্ত কিছু জোগাড় করার ব্যবস্থা করুন। যে পুকুরেই বিক্রয়যোগ্য মাছ তৈরি হয়েছে তা বুঝে তুলে বিক্রি করার ব্যবস্থা করা দরকার।
ছোট পুকুরগুলি, যাতে মাগুরের চাষ করেছেন, তা এ বার তুলে বিক্রির ব্যবস্থা করুন। আঁতুড় পুকুর হিসাবে ব্যবহার করা যায় এমন পুকুরের প্রস্তুতি শুরু করার কথা এখন থেকেই ছকে ফেলুন। সাইপ্রিনাস-এর ডিমপোনা আশাকরি ভালো ভাবেই বড় হয়েছে। তাদের বিক্রি করার ব্যবস্থা করুন অথবা লালন পুকুরে আরও বৃদ্ধির জন্য ছেড়ে দিন।
চুন-প্রয়োগ করা নোনা জলের পুকুরে স্বল্প জল ঢুকিয়ে নিন এবং নীচের মাত্রা অনুসারে সার প্রয়োগ করুন।
গোবর
|
১০০
|
কেজি / বিঘা
|
মুরগির মল
|
২৫
|
কেজি / বিঘা
|
ইউরিয়া
|
৬
|
কেজি
|
সিঙ্গল সুপার ফসফেট
|
৬
|
কেজি
|
প্রয়োগের পর থেকে ১৫ – ২০ দিন ফেলে রাখুন। তার পর ৮০ – ১০০ সেমি জল প্রবেশ করিয়ে তাতে সুস্থ, সবল চিংড়ির বীজ (৪ – ৬ সেমি) বিঘাপ্রতি ৬ – ৮ হাজার হারে মজুত করুন। এর পর প্রতি মাসে বিঘাপ্রতি মুরগির মল ৬ কেজি, ইউরিয়া ২ কেজি, সিঙ্গল সুপার ফসফেট ২ কেজি হিসাবে সার প্রয়োগ করুন। এ ছাড়া প্রতি দিন ৩০ – ৪৫ শতাংশ প্রোটিনযুক্ত কৃত্রিম খাবার প্রথমে দশ শতাংশ হারে প্রয়োগ করুন। পরে ক্রমান্বয়ে তা কমিয়ে ৩ শতাংশ হারে প্রয়োগ করবেন। প্রতি দিন (সম্ভব হলে) ৫ – ৩০ শতাংশ জল পরিবর্তন করতে পারলে ভালো। সব শেষে বলি, সামনের কয়েক মাস কিন্তু মাছচাষিদের কঠোর পরিশ্রমের দিন। এর উপরেই সব সাফল্য নির্ভর করবে। সুতরাং মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিন।
তথ্যসূত্র : মৎস্য বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার