আধুনিক মাছ চাষের খামারে বিভিন্ন রকমের পুকুর থাকা প্রয়োজন। যেমন ডিম ফুটিয়ে পোনা তোলার জন্য আঁতুড়-পুকুর বা লালন-পুকুর দরকার। তার পর চারাপোনার জন্য পালন-পুকুর। এই পালন-পুকুরের আয়তন লালন-পুকুরের মোট আয়তনের কমপক্ষে পাঁচ গুণ হওয়া চাই এবং অধিক পক্ষে বিশ গুণ পর্যন্ত করা যেতে পারে। সবই নির্ভর করছে খামারে উৎপাদিত চারাপোনার সংখ্যার উপর এবং তার কতগুলি পালন-পুকুরে আঙুলে পোনা হিসাবে বড় করা হবে।
আঁতড়-পুকুরে ডিম লালন-পুকুরে পোনা তবেই তো টাকা হাতে যাবে গোনা।
লালন-পুকুরে চারাপোনা বড় করে মজুত-পুকুরে রাখা হয়। লালন-পুকুরে যে পরিমাণ চারাপোনা উৎপন্ন হয় তার সবটাই যদি মজুত-পুকুরে রাখা হয় তবে খামারে মজুত-পুকুরের মোট আয়তন লালন-পুকুরের বিশ গুণ হওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ আপনার খামারে যদি পাঁচ একর পরিমাণ লালন-পুকুর থাকে তবে একশত একর পরিমাণ মজুত-পুকুর থাকা দরকার।
ছোট বড় মেজো নানা রকম কেজো পুকুর থাকা চাই খামার হবে তাই।
কিন্তু অধিকাংশ মাছচাষি বেশির ভাগ চারাপোনা বিক্রি করে অল্প কিছু লালন-পুকুরে রাখেন এবং তার থেকে অনেক আঙুলে পোনা বিক্রি করে অবশিষ্ট কিছু মজুত-পুকুর ছাড়েন। এতেই লাভ বেশি। তাই মজুত-পুকুরের মোট আয়তন এত বেশি না থাকেলও চলে। তাই আপনার খামারের আঁতুড়-পুকুরের মোট আয়তন যদি এক একর হয় তবে লালন-পুকুরের মোট আয়তন কমপক্ষে পাঁচ একর এবং মজুত-পুকুরের মোট আয়তন কমপক্ষে তার পাঁচ গুণ বা পঁচিশ একর হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রয়োজনমতো অধিক অনুপাতে বিশ গুণ করা যেতে পারে।
আকারে ছোট ও অগভীর এবং প্রতি বৎসর শুকিয়ে যায় এমন হওয়া দরকার। সাধারণত মাপে ৫ – ১০ কাঠা এবং তিন থেকে চার ফুট জল থাকে এমন হওয়া চাই।
আকারে তার চেয়ে বড় এবং একটু বেশি গভীর হওয়া প্রয়োজন। সাধারণ মাপে ১০ কাঠা থেকে ২০ কাঠা এবং এক বিঘা পরিমাণ এবং জলের গভীরতা চার থেকে ছয় ফুট হলেই চলে।
তার চেয়ে বড় এবং গভীর হয়। মাপে ১ – ৩ বিঘা বা এক একর পরিমাণ এবং গভীরতা ছয় থেকে আট ফুট।
আধুনিক মৎস্য খামারে মাছের প্রজননের জন্য পাকা মাছ রাখারও প্রয়োজন আছে। গর্ভবতী পাকা মাছেদের নিয়মিত আহার ও পরিচর্যার সঙ্গে প্রজননের উপযুক্ত আলাদা পুকুর থাকা দরকার। একে পাকামাছের পুকুর বলে। আসলে এগুলি এক বা একাধিক বড় মাপের মজুত-পুকুর বলা চলে।
খামারে রোগ মড়ক নিবারণের জন্য হাসপাতাল-পুকুরেরও প্রয়োজন আছে। কোনও পুকুরে হঠাৎ মাছের মড়ক দেখা দিলে, সমস্ত মাছ জাল দিয়ে তুলে অন্যত্র স্থানান্তর করে মাছ বাঁচানো যায়। আবার রোগাক্রান্ত মাছকে আলাদা রাখা উচিত। এতে রোগ বিস্তার কম হয় এবং চিকিৎসার সুবিধা হয়। এ পুকুর মাপে একটি বড় পালন-পুকুরের মতো হলেই চলে।
বাজারে নিত্য মাছ পাঠানোর জন্য খামারে একটি বাজার-পুকুরও থাকা দরকার। যেখানে খামারের উদ্বৃত্ত মাছ জমা করে রাখা যাবে। এবং সহজে জাল দিয়ে টেনে তুলে ভোরবেলাতেই বাজারে পাঠানো যাবে। তবে হ্যাঁ, মাছের খামারে সজাগ এবং কঠোর প্রহরার ব্যবস্থা করতে ভুলবেন না।
খামার তৈরির জন্য স্থান নির্বাচন করতে গিয়ে অনেকগুলি বিষয় বিচার করে দেখা দরকার। যাতে কম খরচে করা যায় এবং পুকুর কাটার পর যাতে জল থাকে এবং অন্যান্য বিপর্যয়ের মধ্যে না পড়তে হয় সেই দিকে লক্ষ রাখা একান্ত কর্তব্য। তাই স্থান নির্বাচনে যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।
কেমন জায়গা তা আগে দেখতে হবে। যে কোনও খামারে তার প্রয়োজনের নানা জিনিস বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। খামারের উৎপাদিত সামগ্রী বাজারে চালান করা দরকার। তাই দেখতে হবে যেন বাজারহাট যাতায়াতের উত্তম ব্যবস্থা ও যানবাহনের সুযোগ আছে কি না। খামারে মানুষজনের প্রয়োজন। সেই সব মানুষজন সহজলোভ্য কি না, তাদের যাতায়াতের সুবন্দোবস্ত আছে কিনা অথবা সহজসাধ্য কিনা তা-ও বিবেচনা করা দরকার।
পরিকল্পনামাফিক জমি পাওয়া যাবে কি না তা দেখা দরকার। একটা পুকুর থেকে অন্য পুকুর বা অফিস, স্টোর ইত্যাদি কাছাকাছি হতে পারে। জমির আয়তন ও গুরুত্ব দিয়ে বিচার করা দরকার।
জমির উপরি তল কেমন তা দেখা দরকার। পুকুর কাটার জন্য উঁচু ঢিব জমি আমরা পছন্দ করব না। এতে খরচ অনেক বেশি পড়বে। অবশ্য যদি ইটের ভাটা ও সঙ্গে মাছ চাষের পরিকল্পনা থাকে তা হলে আলাদা কথা। তবু ইটের ভাটা একটু পরিকল্পনামতো করতে পারলে বিনা খরচায় একটি চমৎকার মাছের খামার হতে পারে। আবার রাস্তা যাঁরা তৈরি করেন তাঁরাও যদি একটু পরিকল্পনা করে দু’ পাশের মাটি কাটেন তবে সুন্দর সুন্দর পুকুর হতে পারে।
উভয় কাজেই প্রচুর মাটি পাওয়া যাবে। সঙ্গে মাছ চাষের জলাশয়ও তৈরি হবে প্রায় বিনা খরচে।
বন্যাক্রান্ত স্থানে খামার তৈরির পরিকল্পনা না করাই উচিত, যদি বন্যার জল খামার থেকে দূরে ঘুরিয়ে দেওয়ার পথ না থাকে। তবে ব্যবস্থা সহজসাধ্য কিনা দেখতে হবে। মাছ চাষের পুকুরকে সব সময় প্লাবনের হাত থেকে বাঁচাতে হবে।
যা-ই হোক মাছ চাষের খামার তৈরির জন্য জায়গাটি উঁচু পাহাড়ি বা সমতল না হলেই ভালো। পুকুর কাটার জন্য নিচু গর্তমতো পতিত জমি পছন্দ করাই লাভজনক। মজে যাওয়া বিল বা পুরাতন দিঘি, পতিত জলাশয় উদ্ধার করে পছন্দমতো বিভিন্ন পুকুরে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। এই সব ক্ষেত্রে দেখতে হবে দীঘি বা বিলের তলায় পাঁক শক্ত হয়ে জমে গেছে কিনা।
জলাশয়ের নীচের মাটি বা পাঁকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। প্রথমত পুকুরের নীচের মাটি তুলে পাড় তৈরি হয় এবং ওই মাটির উপরেই পুকুরের ধার বা পাড় তৈরি করতে হয়। উভয় ক্ষেত্রেই শুষ্ক পাঁক যদি শক্ত না হয় তবে বাঁধ তৈরি ও তার টিকে থাকা কঠিন। পাড় ছাড়া পুকুর সম্ভব নয়। যদি তলায় পাঁক শক্ত হয়ে জমে না গিয়ে থাকে তবে এ কাজে অগ্রসর হওয়া উচিত নয়। কারণ শুষ্ক জলাশয়ের বা পতিত নিচু জমির তলে যদি নরম পাঁক থাকে তবে সেখানে আল বা বাঁধ দাঁড়াবে না। আর সেই এলাকা ভাগ করে পরিকল্পনামতো বিভিন্ন পুকুরও তৈরি হবে না। পুকুর কাটার নিচু জমি বেশ উপযুক্ত ও কম খরচে পুকুর তৈরি সম্ভব।
এই সমস্ত নিচু জমি বা মজে যাওয়া জলাশয়ের মধ্যভাগ বেশি গভীর হয়। তাই বাঁধ দিয়ে যদি এই সব অগভীর বা কিনারা অঞ্চলে অগভীর পুকুরগুলি যেমন আঁতুড়-পুকুর, লালন-পুকুর ইত্যাদি নির্মাণ করা যায় এবং গভীর মধ্যাংশে গভীরতর পুকুরগুলি সাজিয়ে নেওয়া যায় তা হলেই খামার গঠনের পরিকল্পনা স্বল্প ব্যয়ে সফল হবে।
পুকুরের তলদেশের মাটি নরম ও কাদামাটি হওয়া প্রয়োজন। পুকুরের জলধারণ ক্ষমতা তলদেশের মাটির ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। চুইয়ে নীচের দিকে জল চলে যাওয়ার প্রবণতা যেন কম থাকে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদনে জলাশয়ের তলদেশের মাটির গুরুত্ব অনেক । নিম্ন জল স্তরের মাছও কাদামাটি পছন্দ করে।
যে মাটিতে পুকুর কাটা হবে সেখানে পরীক্ষামূলক ভাবে কয়েক জায়গায় গর্ত খুঁড়ে আগে দেখে নিতে হবে নীচের স্তরের মাটি কেমন? অর্থাৎ প্রয়োজনীয় গভীরতায় বা পুকুরের তলদেশে কেমন মাটি দাঁড়াবে। নীচে কেবলমাত্র বালি মাটির স্তর থাকলে সেখানে পুকুর না কাটাই ভালো। চুনাপাথর বা কাঁকর মাটিও পরিত্যাগ করে চলা উচিত। নদীর আশেপাশে ও শুকনো নদীর উপর বালি মাটির স্তর বেশি। তাই সেখানে পুকুর কাটলে জল থাকে না।
পুকুর তৈরির পক্ষে সব চেয়ে উপযোগী মাটি এঁটেল–দোঁয়াশ পলিমাটি অথবা এঁটেল মাটি। কালো পলিমাটির জল ধারণক্ষমতা বেশি, লাল মাটির বা হলদে মাটির জলধারণ ক্ষমতা কম। যদি এমন জায়গায় পুকুর হয় যেখানে জল থাকে না তবে পুকুরের তলদেশে কাদামাটি ফেলে এ সমস্যা দূর করা যায়। সে ক্ষেত্রে শুরুতেই খরচ অনেক বেড়ে যাবে।
খামারের পুকুরগুলি যাতে উপযুক্ত পরিমাণ জলে পূর্ণ থাকে তার ব্যবস্থা থাকা দরকার। নিকটের কোন খাল, নদীস্রোত বা জলাশয় থেকে জলের প্রয়োজন মেটানো যেতে পারে। তাই যে জমিতে পুকুর কাটানো হবে সেই জমিতে জল নিষ্কাশন এবং প্রবেশের সুবিধা-অসুবিধা আছে কি না দেখে নেওয়া দরকার। আমাদের দেশে বৃষ্টিপাত মোটামুটি ভালো। অধিকাংশ পুকুরই বৃষ্টিনির্ভর অর্থাৎ বৃষ্টির জলে ভরে থাকে। তাই প্রয়োজনমতো বৃষ্টির জল ঢুকিয়ে নেওয়ার বা বার করে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা দরকার। এ ছাড়া নলকূপের সাহায্যেও পুকুরে জল ভরা যায়। আধুনিক মৎস্যচাষ খামারে নলকূপ অপরিহার্য। কারণ আকাশের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে থাকা ঠিক নয়। বৃষ্টিপাত অনেক সময় বিলম্বিত হয়। তা ছাড়া একটু আগেভাগে পোনা উৎপাদন করতে হলে পুকুরে জল প্রয়োগ বাঞ্ছনীয়। অথবা গ্রীষ্মের তাপে জল কমে গেলে পুকুরে জল বাড়াতে হবে। পুকুরে জল পাল্টাতে হলেও নলকূপ খুব উপযোগী।
খামারে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পুকুরগুলির অনুপাত ঠিক রেখে পছন্দমতো স্থানে মাছ চাষের খামার গঠনের জন্য আগে একটা নকশা করা দরকার। আগেই মাছ চাষের খামারে বিভিন্ন পুকুরের আকার, আয়তন কেমন হবে, সেই সব পুকুর কতটা গভীর হবে, এই সব দিক আগে থেকে ভেবে রাখা দরকার। সব চেয়ে আগে পছন্দমতো স্থানটি জরিপ করে তার একটা নকশা তৈরি করতে হবে। সেই নকশায় জমির উপরি তলের চিত্র কেমন তা বোঝানো দরকার অর্থাৎ কোন দিক কতখানি উচুঁ বা নিচু, কতটাই বা গভীর, ওই নকশায় সব উল্লেখ থাকা দরকার। সেই নকশা অনুসারে গভীরতর দিকে বড় পুকুরগুলি এবং অপেক্ষাকৃত কম গভীর অংশে ছোট পুকুরগুলি সাজিয়ে নিতে হবে। পুকুরগুলির মাপ নকশার উপরে ঠিক ঠিক লিখে নিতে হবে। পুকুরগুলি তৈরি করতে যে বাঁধ তুলতে হবে তার স্থানও রাখতে হবে।
পুকুর তৈরিতে বাঁধ বা পাড় গঠন সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পুকুরের গভীরতা বেশি হলে বাঁধও বেশি চওড়া হবে। পুকুরের মাপ ও জল ধারণক্ষমতা ও গভীরতার উপর বাঁধের চওড়া, উচ্চতা ও ঢাল নির্ভর করে। সাধারণত অগভীর ছোট পুকুরের বাঁধের উপরিভাগ তিন ফুটের মতো চওড়া হলেই চলে। তবে গভীর বড় পুকুরের বাঁধের উপরিভাগ ছ’ ফুট মতো চওড়া হওয়া প্রয়োজন। বাঁধ চওড়া হলে স্থায়ী হয় এবং রাস্থা হিসাবে ব্যবহারের সুবিধা হয়। বাঁধ নির্মাণে নিন্মলিখিত সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন —
বাঁধের ঢাল ১ : ২ অনুপাতের অর্থ হল প্রতি এক ফুট উচ্চতায় বাঁধের পাদদেশে দু’ ফুট ঢালের বিস্তার। আর ১ : ১ অনুপাতের অর্থ হল প্রতি ফুট উচ্চতায় পাদদেশে সমান দূরত্বে ঢালের বিস্তার। তা হলে হিসাব করা যাক, একটি দশ ফুট উঁচু এবং উপরে ছয় ফুট চওড়া বাঁধের পাদদেশ মোট কতটা চওড়া হবে যদি তার বাইরের দিকে ঢালের অনুপাত ১ : ১ এবং ভিতর দিকে ১ : ২ হয়। বাইরের ঢাল উচ্চতার সমান অর্থাৎ ১০ ফুট + বাঁধের চওড়া মধ্যস্থল ৬ ফুট + ভিতর দিকের ঢাল উচ্চতার দ্বিগুণ অর্থাৎ ২০ ফুট = মোট ৩৬ ফুট চওড়া হবে।
সূত্র : মৎস্য বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
সর্বশেষ সংশোধন করা : 12/15/2019