পুকুরে যখন মাছ মরতে দেখা যায় তার অনেক আগে থেকেই তার মৃত্যুর কারণ ঘটে থাকে। আমরা যখন দেখতে পাই তখন প্রায় মড়ক আকার ধারণ করার পর। মাছের মৃত্যু বা মড়ক নানা কারণে হয়ে থাকে।
মাছের মৃত্যু বা মড়কের কারণগুলি হল —
- (ক) ভৌত কারণ
- (খ) রাসায়নিক কারণ, ও
- (গ) জৈবিক কারণ
মড়কের লক্ষণ
এই সময় মাছ উপরের দিকে ভেসে ভেসে আসে। খাবি খায়। আরও বেশি হলে মাছ উল্টে যায় ও পেটের দিকটা দেখা যায়।
ভৌত কারণ
ভৌত কারণগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় —
- (ক) জলের তাপমাত্রা
জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে দেশে, বিশেষ করে গ্রীষ্মপ্রধান দেশে, গ্রীষ্মের প্রখর তাপের সময় জলাশয়ে জল কমে যায়। ফলে জলের তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে অনেক সময় মাছের মৃত্যু ঘটে। কাতলা বা উপরি স্তরের মাছ আগে আক্রান্ত হয়। অগভীর জাতীয় জলাশয়ে মাছ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। জলের তাপমাত্রা খুব কমে গেলেও মাছের মৃত্যু হতে পারে।
জলের তাপমাত্রাকে দু’ ভাগে ভাগ করা হয় —
- (ক) খুব কম তাপমাত্রা, ও
- (খ) খুব বেশি তাপমাত্রা।
- (খ) জল অতিরিক্ত ঘোলা, ও
জলাশয়ের জল যদি অত্যাধিক ঘোলা হলেও মাছের মড়ক লাগে। জলে পলিমাটি অথবা সবুজ কণা জমে গিয়ে জল ঘোলা হয়। মাছের শ্বাসক্রিয়ার সময় এই অবস্থা ভীষণ ক্ষতি কারক। ফুলকার উপরেও এ গুলি জমতে থাকে। শ্বাস ক্রিয়ার ব্যাঘাত ঘটে। বেশি হলে মাছ মারা যায়।
- (গ) অগভীর জল
জলাশয় যদি অগভীর হয় কিংবা জলাশয়ে যদি বেশি শ্যাওলা থাকে টা হলে মাছের চলাফেরায় ব্যাঘাত ঘটে। আর শ্যাওলার পরিমাণ আরও বেশি হলে এর ফাঁদে পড়ে অনেক সময় মাছ মারা যায়। শ্যাওলা বা জলজ উদ্ভিদ খুব বেশি থাকলে ভোরের দিকে জলে অক্সিজেনের অভাবে অনেক মাছের মৃত্যু হয়।
রাসায়নিক কারণ
রাসায়নিক কারণগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা হয় —
- (ক) অক্সিজেনের ঘাটতি
রাসায়নিক কারণের মধ্যে জলে অক্সিজেন ঘাটতি মাছের মৃত্যুর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। জলে অক্সিজেনের ঘাটতি নানা কারণে হয়ে থাকে —
- (১) অত্যাধিক মাছের সংখ্যা।
- (২) জলাশয়ে অত্যাধিক শ্যাওলা বা ছোট ছোট উদ্ভিদ থাকলে তাদের শ্বাসক্রিয়ার জন্য প্রচুর অক্সিজেন লাগে। কিন্তু রাত্রে সূর্যের আলোর অভাবে গাছের সালোকসংশ্লেষ না হওয়ার কারণে বিশেষ করে সকালের দিকে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়।
- (৩) বিভিন্ন উদ্ভিদ ও জলজ প্রাণীদেহের পচনের ফলেও অক্সিজেনের অভাব হয়ে থাকে।
- (৪) সকালের দিকে বৃষ্টি হলে বা মেঘলা হলেও অক্সিজেনের ঘাটতি হতে পারে। তখন শ্বাসক্রিয়া চালানোর জন্য মাছেরা উপরে অক্সিজেনের পাওয়ার জন্য ভেসে আসে।
- (৫) কয়েক দিন মেঘলা থাকার পর হঠাৎ বৃষ্টি হলে অক্সিজেন-সমৃদ্ধ ভারী জল নীচের দিকে চলে যায়। ফলে উপরের স্তরে অক্সিজেনের অভাব ঘটে। এই অবস্থায় হেক্টর প্রতি ৫০০ কেজি হারে কলিচুন অথবা ৩ কেজি পরিমাণ পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট জলের সঙ্গে গুলে ভালো করে ছিটিয়ে দিলে কিছু লাভ হয়। এ ছাড়া জলাশয়ের জল লাঠি দিয়ে পিটিয়ে, সাঁতার কেটে বা চাকা ঘুরিয়ে তোলপাড় করলেও কিছু লাভ হয়। সম্ভব হলে ভালো জল প্রবেশ করানো যেতে পারে।
- (খ) বিষাক্ত গ্যাস
বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হয়ে ওই গ্যাস জলে মিশে থাকলে সেই জলের মাছ মারা যায়। পচা পুকুরের তলদেশে মিথেন, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি গ্যাস প্রায়শই তৈরি হয় এবং সেই পুকুরে মাছের মৃত্যুর কারণ হয়। পুকুরে পচা ড্রেনের জল এসে পড়েও অনেক সময় এই দূষণ হয়ে থাকে। এই রকম আক্রান্ত মাছ আসলে অসুস্থ নয়। পরিবেশ অসুস্থ, তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এদের স্থানান্তরিত করা যায় ততই মঙ্গল।
- (গ) বিষ প্রয়োগ
অনেক সময় ইচ্ছায় (শত্রুতাবশত ) বা অনিচ্ছায় (চাষের কাজের রোগ পোকা দমনের ) বিষ প্রয়োগ সমস্ত জলকে বিষাক্ত করে দেয়। মাছ খুব কম বিষেই আক্রন্ত হয় ও মড়ক লেগে যায়। সাবধানতায়ই একমাত্র পথ যাতে এই রকম বিষ পুকুরের জলে না মিশতে পারে। এ ছাড়াও শুরুতেই যদি মাছ ধরে অন্যত্র পাঠানো যায় তা হলে মরক থেকে মাছ বাঁচানো যেতে পারে।
জৈব কারণ
- (১) মাছ অনেক সময় তার ডিম বা ছোট মাছ খেয়ে নেয়। খাদ্যের অভাবে এটা বেশি হয় তাই জলাশয়ে যথেষ্ট খাবার যেন থাকে। সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
- (২) মৎস্যভুক মাছের পেটে বহু মাছ মারা পড়ে -- কিছু কিছু মাছ আছে যারা মাংসাশী। তারা জলের জুপ্ল্যাঙ্কটন খেয়ে জীবন ধারণ করলেও জলজ প্রাণী এবং তাদের তুলনায় ছোট মাছ তাদের ভীষণ পছন্দের খাবার। এই সব মাছ জলাশয়ে থাকলে অন্য মাছের শরীর ভালো বৃদ্ধি হয়। কারণ মৎস্যভুক তাড়া খেয়ে এরা ছোটাছুটি করে। ফলে এদের ব্যায়াম হয়। শরীর সুস্থ থাকে ও বাড়বৃদ্ধি হয়। কিন্তু সংখ্যা খুবই সীমিত ভালো বা না থাকা ভালো। যেমন — চিতল, বোয়াল, পাঙাস, হাইব্রিড মাগুর, তেলাপিয়া, ভেটকি ইত্যাদি।
- (৩) মৎস্যভুক প্রাণী : উদবিড়াল, নানা পাখি, ব্যাঙ, সাপ (বিশেষ করে জলজ সাপ) জলে অথবা জলাশয়ের সন্নিকটে আশ্রয় করলে পুকুরের মাছ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। এদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য উপযুক্ত উপায় অবলম্বন করতে হবে।
- (৪) ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরজীবি প্রাণী ও সূক্ষ্ম জীবাণু : মাছের মড়কের প্রধান কারণের মধ্যে এটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সূক্ষ্ম জীবাণুর মধ্যে ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ও ফাঙ্গাস প্রধান। আমাদের আসাবধানতার সুযোগ পেলেই এরা মাছেদের আক্রমণ করে। ব্যাক্টেরিয়া আক্রান্ত মাছের কয়েকটি রোগ যেমন —
- (ক) পাখনা ও লেজ পচা রোগ। এই রোগ পাখনা বা লেজের কিনারা দিয়ে শুরু হয়। শরীরে ছড়িয়ে পড়ে লেজ পাখনা খসে যায়।
- (খ) উদরি বা শোথ রোগে শরীরে জল জমে, পেট ফুলে যায়। আঁশগুলি অনেকটা খাড়া হয়ে যায়। রোগটি ছোঁয়াচে। প্রতিকারও কঠিন। মাছ তুলে ফেলা ভালো।
- (গ) চোখের রোগে চোখ অন্ধ হয়ে যায়। বেশি আক্রান্ত হলে মাছ তুলে অন্য পুকুরে দেওয়া বা উপযুক্ত পরিমাণে চুন প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ফাঙ্গাসঘটিত কয়েকটি রোগের মধ্যে —
- (ক) পাখনা পচা রোগ,
- (খ) ফুলকা পচা রোগ ইত্যাদি।
জৈবিক কারণগুলিকে আবার পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয় —
ভাইরাসঘটিত রোগ
পরজীবী প্রাণীঘটিত রোগের মধ্যে প্রধান
- (ক) কৃমি জনিত রোগ— চ্যাপটা কৃমি (ট্রেমাটোড) হুকের সাহায্যে মাছের দেহে লেগে থাকে, ফুলকায় লেগে রক্ত শোষণ করে।
- খ) ফিতা কৃমি (ক্যাস্টোড) -- এরা জীবনচক্রের একটা অংশ মাছের পেটের মধ্যে কাটায়।
- (গ) কবচী প্রাণী মাছের এক ধরনের উকুন।
সুত্রঃ পোর্টাল কনটেন্ট টিম