যে পুকুরে ছোট মাছ, সাধারণত চারা পোনা বা আঙুলে মাছের বাচ্চা, ছেড়ে তাদের স্বাস্থ্যরক্ষা ও বৃদ্ধির জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করা ও খাদ্য সরবরাহ করা হয়, তাকেই মজুত পুকুর বা স্টকিং পন্ড বলা হয়। অনেক সময় ধানিপোনা ছেড়েও তাদের বড় করা হয়।
মজুত পুকুরে মাছ চাষের উদ্দেশ্য হল সুস্থ পরিবেশে তাড়াতাড়ি মাছের বাচ্চার বৃদ্ধি ঘটানো। অর্থনৈতিক মাপকাটিতে লাভজনক, সামাজিক চাহিদার উপযুক্ত, পরিবেশ ও কানুনকে মাথায় রেখে বৃদ্ধির পর মাছগুলিকে বাজারজাত করা হয়। বিভিন্ন বয়সের এবং ওজনের প্রয়োজন অনুসারে বাজারজাত করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রকারের মাছও মজুত পুকুরে বড় করা হয়ে থাকে।
প্রথার তারতম্য অনুসারে মজুত পুকুরে মাছ চাষকে একক, মিশ্র এবং কম্পোজিট এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যখন কোনও পুকুরে একই জাতীয় মাছ চাষ করা হয় তখন সেই প্রথাকে একক মাছ চাষ বলে। এটি একটি পুরাতন প্রথা। ধরা যাক যে পকুরে কাতলা মাছের চাষ হবে সেখানে আর কোনও জাতের মাছ থাকবে না। মৃগেল, রুই বা গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প অথবা তেলাপিয়া বা মাগুর যা-ই হোক না কেন, তার একক চাষ হতে পারে। এই প্রথায় রুই, কাতলা অথবা মৃগেল বিঘায় ৫০০ – ৭০০ বা প্রতি হেক্টরে ৩৭৫০ – ৫২০০টি এবং তেলাপিয়া বা মাগুর ওই সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ চাষ হয়ে থাকে। তবে এই চাষ খুব বিজ্ঞানসম্মত নয়। কারণ অন্যান্য সকলের মতো মাছেরও নানা প্রজাতির চরিত্র-চাহিদা-অভ্যাস ভিন্ন ভিন্ন, তাই একই প্রকার মাছের চাষে পুকুরের সমস্ত প্রাকৃতিক ও প্রদত্ত সম্পদ যা মাছেদের প্রয়োজন সেগুলির সুষ্ঠু বন্টন বা ব্যবহার হয় না। ফলে জলাশয়ের এক ধরনের খাবার ও অন্যান্য সুবিধা একই জলস্তর থেকে যখন নিঃশেষিত হবে, তখন অন্য দিকে অন্য সুবিধাগুলি অন্য জল স্তরে অব্যবহৃত বা অপব্যবহৃত হবে বা নষ্ট হবে। এই পদ্ধতিতে এক রকম মাছ থাকার ফলে মাছের রোগ-পোকা বৃদ্ধি হয়, মাছের শ্বাসকষ্ট হয় ও বৃদ্ধিও কম দেখা যায়। মূল লক্ষ্য যেটা সেই উৎপাদনও বিঘ্নিত হয়। তাই মাছের মিশ্র চাষ সব দিক থেকেই অনেক ভাল ও উৎপাদনশীল।
জলাশয়ের পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক যে সকল সুবিধা মাছ চাষে পাওয়া যায় এবং জলের প্রাকৃতিক ও প্রদত্ত সম্পদ যা মাছের খাদ্য ও জীবনের অন্যান্য সুখসুবিধার জন্য প্রয়োজন সেগুলির সুষ্টু বন্টন ও সদ্ব্যবহার হবে যদি বিভিন্ন জাতের মাছ চাষ করা হয়। বিভিন্ন জাতের এই মাছ চাষকে মিশ্র চাষ বলে।
মিশ্র চাষে আমরা সে দিন অবধিও রুই কাতলা ও মৃগেল মাছের চাষ করতাম। কারণ বাজারে এই তিন প্রকার মাছের চাহিদা প্রায় একই রকম। কিন্তু এই তিনটি প্রজাতির খাদ্যাভ্যাস, বসবাস, আচার-আচরণ অনেকটাই ভিন্ন। রুই মাছ পুকুরের মধ্য জলস্তরে বিচরণ করে। ছোট অবস্থায় এরা জুপ্লাঙ্কটন বা প্রাণীকণা খায়। বড় হলে অর্থাৎ চারাপোনার পর থেকে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন বা উদ্ভিদকণা, প্রাণীকণা, জলজ উদ্ভিদের নরম পাতা, পচা গলা উদ্ভিদের অংশ ইত্যাদি খায়। কাতলা মাছ, মৃগেল মাছ পুকুরের উপরের জলস্তরে থাকে। ছোট অবস্থায় প্রাণীকণা খায় কিন্তু বড় হলে উদ্ভিদকণা, প্রাণীকণা, শ্যাওলা, প্রদত্ত খাবার ইত্যাদি খায়। মৃগেল মাছ পুকুরের তলদেশে থাকে। ছোট অবস্থায় প্রাণীকণা খায়। বড় হলে উদ্ভিদকণা, প্রাণীকণা, শ্যাওলা, পচাগলা প্রদত্ত খাবারের সঙ্গে নরম কাদামাটিও খায়। এই ভিন্নতাকে কাজে লাগিয়ে এই প্রথায় মাছ চাষ করে, জলাশয়ের ও মাছের যথাসম্ভব সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করা হত, এখনও হয়। ফলে জলের সমস্ত স্তরের খাবার ও প্রাকৃতিক সুযোগসুবিধা তাদের প্রয়োজনমতো নিতে নিজের প্রজাতির মধ্যে হলেও ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে হয় না। এই জন্য একই আয়তনের পুকুরে বা একই ঘনত্বের জলাশয়ে এক প্রজাতির মাছ অধিকতম যে সংখ্যায় করা সম্ভব মিশ্র চাষে সর্বমোট সংখ্যা তার প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে এবং সেই অনুপাতে ফলনও। এই প্রথায় কাতলা : রুই : মৃগেল (৪ : ৩ : ৩ ) হারে বিঘা প্রতি ৯০০ – ১৬০০ বা হেক্টর প্রতি ৬৭৫০ – ১২০০০টি চারা মাছ ছাড়া হয়ে থাকে। আমরা প্রায়শই আমাদের পুকুরে এই ধরনের মাছের সাথে ছোট জাতের অথচ খুব সুস্বাদু মাছ যেমন — বাটা, সরপুঁটি, জাপানি পুঁটি, মৌরালা, চিংড়ি, গলদা চিংড়ি ইত্যাদি মাছের চাষ করে থাকি। সে ক্ষেত্রে আমরা বড় জাতের মাছের অনুপাত বা সংখ্যা একই রকম রেখে অল্প অল্প অন্যান্য ছোট জাতের ছাড়তে পারি --- কখনও বা বড় জাতের মাছের সংখ্যা ঈষৎ কমানো হয়। প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে জাল টেনে কিছু কিছু মাছ নিজেদের জন্য বা বাজারজাত করার জন্য ধরা যেতে পারে।
আমাদের অনেক সময় কিছু সামাজিক সমস্যা থাকায় আমরা অনেক ক্ষেত্রে মাছ খুব বড় করতে পারি না। এ ছাড়া বাজারে ছোট জ্যান্ত টাটকা মাছের চাহিদাও আছে খুব। এই সব কথা মাথায় রেখে পর্যায়ক্রমে বারংবার ছোট (১৫০ – ৩০০ গ্রাম ওজনের) মাছ ধরে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সুবিধামতো বিক্রি করা আজকাল একটা লাভজনক মাছ চাষ পদ্ধতি। এই পদ্ধতি লাভজনক। সেই সাথে চাষির প্রয়োজনমতো ঘন ঘন টাকা উপায়ও হয়ে থাকে। সাধারণ চাষে মাছের চারা ছাড়ার পরে মাছ বড় হলে এক সাথে মাছ ধরে, বাজারে পাঠানো হয়ে থাকে। কিন্তু এই পদ্ধতিতে রুই, কাতলা ও মৃগেল / রুই - গ্রাস কার্প / কাতলা – সিলভার কার্প / মৃগেল – সাইপ্রিনাস কার্প অথবা প্রয়োজনে এদের সাথে অন্য ছোট জাতের মাছও তাদের অনুপাত অনুযায়ী একটু অধিক সংখ্যায় মাছের চারা পুকুরে প্রয়োগ করা হয় (১৫ – ৫০ গ্রাম ওজনের বড় জাতের মাছ )। পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার প্রয়োগ করা হয়, সজাগ দৃষ্টি রাখা হয় যেন কোনও রকম দূষণ না হয়। এর পর জলাশয় থেকে নিজের আর্থিক প্রয়োজনমতো এবং বাজারের চাহিদা অনুযায়ী (১৫০ – ৩০০ গ্রাম ওজনের মাছ থেকে শুরু) মাছ ধরে বাজারজাত করা হয়। প্রতি বার মাছ ধরার সময় সমসংখ্যক চারাপোনা (১৫ – ৫০ গ্রাম ওজনের অন্য জলাশয়ের) জোগাড় করে ছাড়া হয়। এই পদ্ধতি চলতে থাকে।
রুই, কাতলা, মৃগেল মাছ পুকুরে তার অনুপাত ও যথাসম্ভব সংখ্যা বজায় রেখে তাদের প্রয়োজনীয় খাবার ও পরিবেশের ব্যবস্থা করে বছরে বিঘাপ্রতি ১০০ থেকে ১৪০ কেজি (হেক্টরে ৭৫০ থেকে ১০৫০ কেজি) মাছ বছরে পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে রুই, কাতলা, মৃগেলের সাথে গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প ও সাইপ্রিনাস কার্প এক সাথে চাষ করে দেখা গেছে এই উৎপাদন আরও কিছু বাড়ানো যায় (শতকরা ১০ – ৩৫ ভাগ ) এই পদ্ধতি কম্পোজিট ফিশ কালচার নামে পরিচিত। এই চাষে জলাশয়ের সমস্ত অংশের খাবার ও প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্টু ব্যবহার হয়। এই চাষের বৈশিষ্ট্য হল ---
কাজেই এই ছয় প্রকার মাছ একত্রে চাষ করলে পুকুরে খাদ্য যত জায়গায় সঞ্চিত আছে তা সবই সুষ্ঠু ভাবে ব্যবহৃত হয়। তা ছাড়া এই আপাত নতুন প্রকার মাছগুলির (সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প ও সাইপ্রিনাস কার্প) শারীরিক বৃদ্ধির হারও অপেক্ষাকৃত বেশি। সিলভার কার্প কাতলার চেয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ে। গ্রাস কার্পকে জলজ উদ্ভিদ ঠিকমতো খাওয়াতে পারলে এদের বৃদ্ধি আশাতিরিক্ত হয়। এরা পুকুরের জলজ উদ্ভিদ খেয়ে পুকুরের জলকে শ্যাওলামুক্ত করতে পটু। সাইপ্রিনাস কার্প মৃগেলের চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি বাড়ে। ফলে সর্বমোট উৎপাদন বেশ উল্লেখযোগ্য ভাবেই বাড়ে। তবে সমস্যা যে নেই তা নয়। এই মাছগুলির চাহিদা অপেক্ষাকৃত কম।
মজুত পুকুরে বৃদ্ধির জন্য মাছ অনেক দিন ধরে রাখা হয়। একক চাষ, মিশ্র, কম্পোজিট, যে প্রথাতেই হোক না কেন, ছোট আঙুলে মাছ বা চারাপোনা (১৫ গ্রাম থেকে ৩৫ গ্রাম ) ছাড়া হয়ে থাকে। বিরল ক্ষেত্রে ধানিপোনাও ছাড়া হয়। প্রয়োজনভিত্তিক বা পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী এগুলিকে বাড়তে দেওয়া হয়। এক সাথে বা ক্রমান্বয়ে যে ভাবেই হোক না কেন, পুকুরে অনেক দিন ধরে রাখতে হয়। তাই মজুত পুকুরের জন্য সারা বছর জল থাকবে এমন জলাশয়ই আবশ্যক।
প্রয়োজনে পুকুর থেকে জল বের করা বা জল প্রয়োগের ব্যবস্থা থাকলে ভালো। যে হেতু পুকুরে এক সাথে নানা প্রকারের মাছ চাষ করা হয়, জলের গভীরতা ১.৫ মিটার থেকে ২ মিটারের (৪ ফুট থেকে ৬ ফুট) মধ্যে হওয়া বাঞ্ছনীয়। পুকুরের পাড় বেশ উঁচু হওয়া দরকার। জলের উপরিতল থেকে অন্তত ১ মিটার (৩ ফুট) উঁচু হওয়া দরকার। যেন কোনও মতেই অতি বৃষ্টিতেও ভেসে না যায়। পুকুরের তলদেশের মাটি দোআঁশ বা এঁটেল-দোআঁশ হওয়া দরকার। পুরোপুরি বালি বা অতিরিক্ত পাঁক মাছ চাষে বিঘ্ন ঘটায়। পুকুর আয়তাকার এবং আয়তনে ১ বিঘা থেকে ১৫ বিঘা হতে (১০০০ বর্গ মিটার থেকে ১০০০০ বর্গ মিটার) হলে ভালো। পুকুরের চার ধার এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা এমন হওয়া দরকার যেন অবাধে সূর্যকিরণ জলে পড়তে পারে। পুকুরের জলের নিকটবর্তী পাড়ের ক্ষয়রোধের জন্য যেন ঘাস থাকে। পাড়ে ছোট ছোট গাছ লাগানো যেতে পাড়ে কিন্তু জলে ছায়া পড়ে এমন গাছ নয়। নারকেল বা তালগাছ লাগানো যেতে পারে উত্তর ও পশ্চিম দিকে। এরা খুব ছায়া করে না কিন্তু এদের শিকড় পুকুর পাড় সংরক্ষণে সাহায্য করে।
পুকুরে মাছের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ক্ষতি করে, গ্রাস কার্পের খাদ্য নয় এমন সব জলজ উদ্ভিদ ও শ্যাওলা নিধন করা দরকার। এরা মাছের চলাফেরা ও জীবনধারণে নানা ক্ষতি করতে পারে।
পুকুরে অনেক মাছ জন্মে বা কোনও ভাবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রবেশ করে যারা মাছ চাষে ক্ষতি করে। এরা অন্যদের খাবারে ভাগ বসায়, চলাফেরায় অসুবিধা ঘটায়। অনেক রাক্ষুসে মাছ আছে যারা চাষের মাছকে বিভিন্ন বয়সে খেয়ে ফেলে। এদের নিধন করা দরকার। পুকুরে মহুয়া খোল প্রয়োগ করলে এর বিষক্রিয়ার ফলে সমস্ত আমাছা, ছোট বড় জলজ কীট সব মারা যাবে। বিঘা প্রতি সাধারণত ২০০ – ২৫০ কেজি মহুয়া খোল প্রয়োগ করা হয়।
এই খোলের পরিমাণ নির্ভর করে পুকুরে কতটা জল আছে তার উপর। আসল হিসাব ২৫০ পিপিএম হারে মহুয়া খোল প্রয়োগ করা প্রয়োজন। অর্থাৎ প্রতি লিটার জলে ২৫০ মিলিগ্রাম খৈল। এই খৈলে স্যাপোনিন নামক এক প্রকার রাসায়নিক আছে যা আমাছা বা জলজ কীটের মৃত্যু ঘটায়। এই রাসায়নিকের কার্যক্ষমতা ১০ / ১২ দিন অবধি থাকে। দু’ সপ্তাহ পর ওই জলাশয় মাছের বসবাসের উপযুক্ত হয়ে যায়।
কিন্তু মহুয়া খোল বেশ ব্যয়সাধ্য। এ ছাড়া মহুয়া খোল প্রয়োগের প্রথমাবস্থায় ক্ষুদ্র প্রাণীর দেহে বিষক্রিয়া ঘটায়। তাই মহুয়া খোল প্রয়োগের কিছু নিয়মবিধি মেনে চলা দরকার।
মহুয়া খোল প্রয়োগের ৭ দিন পর বিঘা প্রতি ৩০ – ৪০ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হবে।
পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যকণা তৈরিতে সাহায্যের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ দরকার।
মাছ চাষে প্রজাতি নির্বাচন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই নির্বাচন নিজের অর্থনৈতিক দিক, পরিবেশ, উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তার উপর নির্ভরশীল হলেও নীচের বৈশিষ্ট্যগুলি গুরুত্বপূর্ণ।
এই সব দিক বিবেচনা করে বলা যায় রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, সাইপ্রিনাস কার্প, মাগুর, শিঙি ইত্যাদি মাছ চাষ খুবই জনপ্রিয়।
|
বিঘা প্রতি সংখ্যা |
হেক্টর প্রতি সংখ্যা |
অনুপাত |
রুই, কাতলা বা মৃগেল একক চাষ (অধুনা প্রায় অপ্রচলিত) |
৪০০ – ৭০০ |
৩০০০ – ৫২০০ |
|
রুই, কাতলা ও মৃগেল একত্রে (বহুল প্রচলিত ) |
৯০০ – ১৬০০ |
৬৭৫০ – ১২০০০ |
৪ : ২ : ৪ |
রুই- গ্রাস কার্প, কাতলা – সিলভার কার্প ও মৃগেল – সাইপ্রিনাস কার্প |
১০০০ – ১৬০০ |
৭৫০০ – ১২০০০ |
২ : ২ : ১.৫ : ২ : ১ : ১৫ |
রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, জাপানি পুঁটি, বাটা ইত্যাদি (সাধারণত কয়েকটি তেলাপিয়া ছাড়া কোনও রাক্ষুসে বা মাংসাশী মাছ শূন্য ) |
১১০০ – ২০০০ |
৮২৫০ – ১৫০০০ |
২ : ২ : ১.৫ : ২ : ১ : ১৫ |
বি.দ্র. : স্থান, কাল পরিবেশ, উদ্দেশ্য, পরিস্তিতি ও প্রয়োজনে এই সংখ্যা পরিবর্তনশীল ও গ্রহণ যোগ্য।
মাছ চাষের লাভ-লোকসান, ক্ষয়ক্ষতি চারা মাছের গুণাগুণের উপর অনেকটাই নির্ভর করে। নীচের গুণগুলো দেখে নেওয়া দরকার।
মজুত পুকুরে সাধারণত আঙুলে মাছ বা ফিঙ্গারলিং দৈর্ঘ্যের মাছের বাচ্চা ছাড়া হয় বড় করার জন্য। এই উদ্দেশ্যে ধানিপোনা বা ফ্রাই চারাপোনা (২৫ – ৬০ গ্রাম ওজনের) এবং কখনও কখনও বড় মাছও বাজারজাত করার জন্য মজুত রাখা হয়। তবে মুখ্যত আঙুলে মাছ বা ধানিপোনা ছাড়া হয়।
নিজের খামারে প্রস্তুত মাছের চারা ব্যতীত অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাছের চারা অন্য কোথাও থেকে আমদানি করতে হয়। অনেক দূর থেকে আনতে হয়। গতানুগতিক পদ্ধতিতে নদী নালা সমুদ্রকূল থেকে মাছের ডিম, ডিম পোনা (স্পন) সংগ্রহ করা হত। সেখান থেকে কোনও ডিম ফোটানো হাপা বা লালন পুকুরে রাখা হত। এখন এর সাথে নতুন প্রণোদিত প্রজননের থেকে প্রাপ্ত মাছের বাচ্চা যুক্ত হয়েছে। মাছের ডিমপোনা, ধানিপোনা বা আঙুলে মাছের স্থানান্তর বা পরিবহন নিয়মিত পদ্ধতিতে না করলে মাছ চাষ সম্ভব নয়।
মাছের ডিমপোনার প্রাকৃতিক উৎসস্থল হল নদী এবং কৃত্রিম প্রজননের উৎসস্থল হল বাঁধ ও হ্যাচারি। এদের চাহিদা সর্বত্র। তাই মাছের বীজ উৎসস্থল থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পরিবহন করা মাছ চাষিদের কাছে একটি সমস্যা।
এ ছাড়া প্রণোদিত প্রজনন ক্ষেত্র থেকেও ডিম, ডিমপোনা, ধানিপোনা বা চারাপোনা বহন করতে হয়। সাধারণত ধানিপোনা আর আঙুলে পোনা বা চারাপোনা মজুত পুকুরে বহন করা হয়। এই কাজ ভীষণ কষ্টসাধ্য এবং অনেক সাবধানতার সঙ্গে করা প্রয়োজন। সাধারণত দু’টি পদ্ধতিতে এই কাজ সম্পন্ন করার প্রথা আছে ---
এটি একটা গতানুগতিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ডিমপোনা বড় অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে মাথায় বা বাঁকে করে হেঁটে, সাইকেল, ভ্যান রিকশা, বাস, লরি এবং ট্রেনে করে বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হয়। একটি হাঁড়িতে কত সংখ্যক ডিমপোনা পরিবহন করা যাবে তা নির্ভর করে হাঁড়ির সাইজ এবং তার মধ্যে থাকা জলের পরিমাণের উপর। সাধারণত ৩০ – ৩৫ লিটার জল ধরে এমন হাঁড়িতে প্রায় ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার ডিমপোনা পরিবহন করা যেতে পারে। যে হাঁড়িতে ডিমপোনা পরিবহন করা হবে সেই হাঁড়িতে ডিমপোনা সংগ্রহের স্থানের জল অর্ধেক বা তার চেয়ে একটু বেশি ভর্তি করে ৫০ – ৬০ গ্রাম লাল মাটি মিশিয়ে দিয়ে ডিমপোনা পরিবহন করা হয়। হাঁড়ির মুখে একটা গামছা থাকে এবং এই গামছার মধ্যে দিয়ে হাত ঢুকিয়ে জল নাড়াতে হয়, যাতে জলের সঙ্গে অক্সিজেন মিশতে পারে। মাঝে মাঝে হাঁড়ির জল ও মাটি পাল্টাতে হয়। কোনও কারণে মরা মাছ ভেসে উঠলে বুঝতে হবে জলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। তখন খুব তাড়াতাড়ি জল থেকে মরা মাছ ফেলে দিয়ে হাঁড়ির জল পালটাতে হয়। এই ভাবে হাঁড়িতে করে ডিমপোনা পরিবহন পদ্ধতিতে উন্মুক্ত পদ্ধতি বলে। তবে এই পদ্ধতিতে ডিমপোনা পরিবহণের সমস্যাগুলো হল —
বর্তমানে ডিমপোনা অর্ধেক জলভর্তি পলিথিন ব্যাগে অক্সিজেন পূর্ণ করে একটা সাধারণ টিনের মধ্যে ভরে নিয়ে বাসে, ট্রেনে এমনকী বিমান পথেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হয়। এই পদ্ধতিকে বদ্ধ পদ্ধতি বলে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ডিমপোনা এবং ধানিপোনা পরিবহন করা যায়। পদ্ধতিটি হল —
এই পদ্ধতিতে ডিমপোনা বা ধানিপোনার মৃত্যুর হার অনেক কম হয় এবং পরিবহন কালে এক বারও জল পালটাতে হয় না। সাধারণত ২৪ ঘণ্টার মতো সময়ে এই ব্যবস্থায় পরিবহনে মাছের পোনার ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম।
মাছকে যখন কোনও পাত্রে জলবন্দি করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পরিবহন করা হয় তখন তাদের বিপাকজাত বর্জ্য পদার্থগুলো ওই জলে জমা হতে থাকে। অ্যামোনিয়া, ইউরিয়া, ইউরিক অ্যাসিড, কার্বন ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি হল প্রধান বিপাকজাত পদার্থ এবং এর প্রতিটি ক্ষতিকর। লক্ষ করা গেছে যে জলে ১ পিপিএম অ্যামোনিয়ার ঘনত্ব বাড়লে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে ১/৭ অংশ কমে যায়। শুধু অক্সিজেন নয়, কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্বও শতকরা ১৫ ভাগ বেড়ে যায় যার ফলে মাছের শ্বাস কষ্ট হয়।
তাই মাছ পরিবহনে হিপনোটিক বা ঘুমপাড়ানি ওষুধ (যেমন সোডিয়াম অ্যামাইটাল ইত্যাদি) ব্যবহার করার ফলে মাছের দেহের শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ ও বিপাক হার কমে যায়। এর ফলে জলপূর্ণ পরিবহণ পাত্রে বিপাকজাত বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ কমে যায় এবং মাছের শ্বাসকষ্ট কম হয়।
মৎস্য দফতরের ক্যাপ্টেন ভেড়ি গবেষণা কেন্দ্রে পরীক্ষা করে দেখা গেছে পরিবহনের সময় ৫ পিপিএম হারে ডিয়াজাপাম গ্রুপের ওষুধ, যেমন ভ্যালিয়াম, ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া যায়।
পছন্দমতো প্রজাতি ও প্রয়োজনমতো সংখ্যার সুস্থ ও সবল মাছের বাচ্চা (ধানি বা আঙুলে) তার উৎসস্থল (প্রাকৃতিক বা প্রণোদিত) থেকে যথাসম্ভব সাবধানতার সঙ্গে বহন করে পুকুর প্রান্তে আনা হয়। এর পর পাত্রের জল পরিবর্তন করা হয়। এই জল সাধারণ উষ্ণতার হয়ে থাকে। অনেক ক্ষণ এই অবস্থায় রাখার পর মাছগুলিকে পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণে (প্রতি মিটার সাধারণ জলে ১ মিলি লিটার পটাশিয়াম পার ম্যাঙ্গানেট) ১ মিনিট কাল রাখার পর পুকুরের জলে সরাসরি না ছেড়ে প্রথমে পাত্রসমেত পুকুরের জলের উপর অনেকক্ষণ রাখা হয় যাতে পুকুরের জলের উষ্ণতার ও পরিবেশের সঙ্গে ধাতস্ত হতে পারে। এই সময় মাছেরা আস্তে আস্তে পাত্রের জল ত্যাগ করে পুকুরের জলে মিশে যায়।
করণীয় কাজগুলো হল —
কারণ এতে পুকুরে শৈবাল আধিক্য হয়ে পুকুরের পরিবেশ নষ্ট করবে। পুকুরের পরিপূরক খাদ্য ব্যবহার করা হলে এর কিছু অংশ নষ্ট হয়ে পচে পুকুরে সারের কাজ করে। তাই পুকুরে ৫ – ৬ মাস মাছ চাষের পর সার প্রয়োগের মাত্রার উপর নজর দিতে হবে। সারের সুফল ভালো ভাবে পেতে হলে উদ্ভিদকণা ও প্রাণীকণার জীবনচক্রের উপর ভিত্তি করে এবং সেচি ডিস্কের দ্বারা জলের স্বচ্ছতা নির্ণয় করে ৭ – ১০ দিন অন্তর খুব হালকা মাত্রায় সার প্রয়োগ করা উচিত। কিন্তু এটা পুরোপুরি নির্ভর করে চাষির অভিজ্ঞতার উপর।
পুকুরে মাছের বৃদ্ধি দ্রুত করার জন্য প্রত্যহ পরিপুরক খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়। চালের কুঁড়োর সঙ্গে সরষে, বাদাম, তিলের মধ্যে যে কোনও এক প্রকার খোল সমান পরিমাণে মিশিয়ে মাছের খাদ্য তৈরি করা হয়। সাধারণত সরষের খোল ও চালের কুঁড়ো সমহারে (১ : ১ অনুপাতে ) মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়। প্রত্যহ মাছের খাদ্যের পরিমাণ এমন ভাবে নির্দিষ্ট করতে হয় যাতে খাদ্যের পরিমাণের সঙ্গে মাছের বৃদ্ধির একটা সমতা থাকে।
একটি পুকুরে ১০০০টি ২৫ গ্রাম ওজনের চারাপোনা ছাড়লে পুকুরে মোট মাছের ওজন হবে মোট মাছের সংখ্যা x একটি মাছের ওজন
অর্থাৎ ১০০০ x ২৫ = ২৫০০০ গ্রাম = ২৫ কিলো গ্রাম
দেহ ওজনের ৩ শতাংশ হারে খাদ্য দিতে হলে মাছ ছাড়ার প্রথম দিনেই খাদ্যের পরিমাণ হবে
১০০ গ্রাম মাছের জন্য প্রতি দিন ৩ গ্রাম খাদ্য
১ গ্রাম মাছের জন্য প্রতি দিন ৩/১০০ গ্রাম খাদ্য
২৫০০০ গ্রাম মাছের জন্য প্রতি দিন (৩/১০০) x ২৫০০০ গ্রাম খাদ্য
= ৭৫০ গ্রাম খাদ্য প্রত্যহ দিতে হবে
বছরের শেষের দিকে মাছ যখন গড়ে ৭০০ গ্রাম হবে তখন ১০০০টি মাছের জন্য পুকুরে মোট মাছের ওজন হবে
মোট মাছের সংখ্যা x একটি মাছের ওজন
অর্থাৎ ১০০০ x ৭০০ = ৭০০০০০ গ্রাম = ৭০০ কিলো গ্রাম
দেহ ওজনের ১.২ শতাংশ হারে খাদ্য দিতে হলে প্রত্যহ খাদ্যের পরিমাণ হবে
১০০ গ্রাম মাছের জন্য প্রতি দিন ১.২ গ্রাম খাদ্য দিতে হবে
১ গ্রাম মাছের জন্য প্রতি দিন ১.২/১০০ গ্রাম খাদ্য দিতে হবে
৭০০০০০ গ্রাম মাছের জন্য প্রতি দিন (১.২/১০০) x ৭০০০০০ গ্রাম খাদ্য দিতে হবে
= ৮ কেজি ৪০০ গ্রাম খাদ্য প্রত্যহ দিতে হবে
কাজেই দেখা যাচ্ছে মাছ যত বাড়ছে প্রাত্যহিক খাদ্যের শতকরা পরিমাণও তার দেহ ওজনের সঙ্গে কমতে থাকছে, কিন্তু মোট খাদ্যের পরিমাণ বাড়ছে।
পরিপূরক খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয়ের পদ্ধতি
পুকুরে দৈনিক কতটা খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে তা নির্ভর করে মাছের দৈহিক ওজনের উপর।
সাধারণত মাছের দৈহিক ওজনের ৩ – ১ শতাংশ হারে পরিপূরক খাদ্য প্রয়োগ করলে উৎপাদন ভালো হয়। মাছের দৈহিক ওজন যত বাড়তে থাকবে খাদ্যের শতকরা পরিমাণও তত কমতে থাকবে। সাধারণত একটি ১০০ গ্রাম ওজনের মাছের জন্য প্রত্যহ খাদ্যের শতকরা পরিমাণ ৩ শতাংশ। এই মাছ যত বাড়বে প্রাত্যহিক খাদ্যের শতকরা পরিমাণও তত কমবে। অর্থাৎ একটি ৭০০ গ্রাম ওজনের মাছের জন্য প্রত্যহ খাদ্যের পরিমাণ হবে তার দেহ ওজনের ১.২ শতাংশ।
তথ্যসূত্র : মৎস্য বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
সর্বশেষ সংশোধন করা : 5/9/2020