মানুষ তার সৃষ্টির প্রথম থেকেই উদর পূর্তির জন্য লড়াই করে চলেছে। প্রথমে বনের ফল, মূল, পাতা, কাণ্ড, ফুল ইত্যাদি খেয়ে বাঁচত। পরে বনের পশু পাখি শিকার করত। তারও পরে আরম্ভ করে প্রকৃতির বিশাল জল সম্পদ (জলাশয়) থেকে মাছ শিকার করা। পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগই জল। এর বাইরে মানুষের প্রয়োজেন নানা জলাশয়ের সৃষ্টিও হয়েছে। বিশাল সমুদ্র থেকে শুরু করে নদ, নদী, খাল, বিল, পুকুর, ডোবার সৃষ্টি হয়। এগুলিতে যুগ যুগ ধরে মাছ অন্যান্য জলজ প্রাণীর সঙ্গে বংশ বিস্তার করতে থাকে। এ ছাড়া মানুষের প্রচেষ্টাতেও মাছ বিভিন্ন জলাশয়ে পাওয়া যায়। নিজেদের খাবারের জন্য এরা মাছচাষকে জীবিকা হিসাবে ব্যবহার করে। সমাজের বহু ও বিভিন্ন শ্রেণির প্রাণীর বাঁচার তাগিদে সমস্ত জলাশয় থেকেই মাছ উত্পাদন করা ও ধরা হয়। তাই আমাদের জীবনে মাছ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী ও পণ্য। আর বাঙালির জীবনে তো কথাই নেই। কথায় বলে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’। তাই মাছ সম্পর্কে আমাদের কিছু জানা খুব দরকার।
খুব সাধারণ ভাবে জলজ প্রাণী যেমন — রুই, কাতলা, মৃগেল থেকে পুঁটি, কৈ, মাগুর, মায়া ইত্যাদি নানা রকম ছোট বড়, আঁশওয়ালা বা আঁশহীন মাছ এবং কুঁচে, কাঁকড়া, চিংড়িংকেও মাছ বলে থাকি। এইগুলি সবই আমরা খাই। এগুলো প্রতিপালন, আহরণ, ব্যবসা ও নানা রকম জীবন জীবিকার কাজে লাগে। কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় মাছ বলতে বোঝায় —
মাছ একটি প্রোটিন সমৃদ্ধ বা উত্কৃষ্ট আমিষ জাতীয় খাবার। বিশেষ করে যে মানুষেরা আমিষভোগী ও যাদের প্রধান খাদ্য ভাত তাদের কাছে খাদ্য হিসাবে খুব উপযোগী। মাছে শতকরা ১৫ – ২৫ ভাগ প্রোটিন থাকে। এই প্রোটিন পুষ্টিকর ও সহজপাচ্য। মানুষের প্রয়োজনীয় ও উত্কৃষ্ট মানের অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলির অধিকাংশই মাছ থেকে পাওয়া যায়। প্রোটিন ছাড়াও মানুষের দেহের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য খাদ্য উপাদান থাকে। মাছে প্রচুর প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ পদার্থ যেমন — ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, পটাশ ইত্যাদি পাওয়া যায়। মাছে বিদ্যমান ভিটামিন ‘এ’ ও ‘বি’ ভীষণ উত্কৃষ্ট মানের। এ ছাড়া সামুদ্রিক হাঙ্গর জাতীয় মাছের লিভার থেকে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘বি’ সমৃদ্ধ তেল পাওয়া যায়। যার দেশে-বিদেশে ভীষণ চাহিদা ও যার অর্থনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম।
বহু সামুদ্রিক মাছ আছে যেগুলি মানুষ খায় না। সেগুলি বিভিন্ন প্রকার কাজে লাগানো যেতে পারে। যেমন — (ক) এগুলোকে ছোট ছোট টুকরো করে গৃহপালিত মাংসাশী প্রাণীদের খাওয়ানো যেতে পারে। (খ) এগুলো শুকিয়ে শুকিয়ে মাংসাশী প্রাণীদের খাবারের মান উত্কৃষ্ট করার জন্য মেশানো হয়। (গ) গাছের জন্য উত্কৃষ্ট মানের সার তৈরিতে এগুলি কাজে লাগানো হয়।
অনেক মাছের তেলে আলফা ‘লিনোলেনিক অ্যাসিড’ ও ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড প্রচুর পরিমাণে থাকে যেগুলো মানুষের শরীরে খুব প্রয়োজন। এইচ ডি এল এবং এল ইড এল অনুকূল মাত্রায় বজায় রাখে যা মানুষের নীরোগ ও স্বাস্থ্যরক্ষায় সহায়ক।
মাছের আঁশ থেকে কৃত্রিম মুক্তো, আঠা ও বিভিন্ন প্রকার খেলনা তৈরি করে কুটির শিল্পের সুযোগ সৃষ্টি করা হয় ও অর্থ রোজগারের মাধ্যম হিসাবে গড়ে তোলা হয়। আমরা ফাইলেরিয়া, ম্যালেরিয়া, এনকেফ্যালাইটিস ইত্যাদি রোগে ভুগি। এই রোগগুলোর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ মশা। পূর্ণাঙ্গ মশার কামড়ের জন্য এই রোগের সৃষ্টি ও বিস্তৃতি হয়ে থাকে। মশার চারটি দশা — ডিম, শূককীট, মুককীট ও পূর্ণাঙ্গ মশা। বিভিন্ন মাছ বিভিন্ন পরিবেশে মশার এই চারটি দশারই শত্রু। ডিম, শুককীট, মুককীট ও পুর্ণাঙ্গ মশাকে মাছ খেয়ে তাদের বংশ বিস্তারে বিঘ্ন ঘটায়। ল্যাটা, কৈ, তেচোখা, খলসে প্রভৃতি মাছ মশার যম। এ ছাড়া সমস্ত মাংসাশী মাছই কমবেশি মশার বংশবিস্তারে বাধার সৃষ্টি ঘটায়। আমাদের জলাশয়গুলি বিভিন্ন কারণে দূষিত হয়। মানুষের ব্যবহারের বা মাছ চাষের উপযোগী থাকে না। অনেক মাছ আছে যেগুলো জলের এই দূষণ থেকে জলকে মুক্ত করতে পারে। কলকারখানার বর্জ্য পদার্থের ফলে জল দূষণ হলে কিছু কিছু মাছ আছে যেগুলো ওই জলে বেঁচে থাকতে পারে ও জলকে দূষণ মুক্ত করে, যেমন তেলাপিয়া। জলাশয়ে নানা রকম পানা ও শ্যাওলা অনেক সময় মাছ চাষ বা অন্য উদ্দেশ্য সাধনে বাধা হয়ে থাকে। শাকাহারী কিছু মাছ, যেমন গ্রাস ক্রাব এই সব জলাশয়ে খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় ও জলাশয়কে পানা মুক্ত করে।
রাতে কিছু কিছু মাছ খুব কর্ম ব্যস্ত থাকে এবং খাবার খায়। এদের মধ্যে মাংসাশী যারা (কৈ, মাগুর, শিঙি ইত্যাদি) রাতের কীটপতঙ্গ খায়। ধানের জমির কীটপতঙ্গ খেয়ে এবং গাছের গোড়া পরিষ্কারে যথেষ্ট সাহায্য করে।
|
|
|
সাগর থেকে শুরু করে রঙিন মাছ পালনের জন্য ছোট ছোট ঘরের অ্যাকোয়ারিয়াম মাছের বসবাস প্রয়োজন ও বৃদ্ধির স্থান।
সুত্রঃপোর্টাল কনটেন্ট টিম
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/29/2020