আমাদের দেশে অধিকাংশ মাছচাষি পালক মাছচাষি। তাঁরা মাছের পোনা জোগাড় করেন, তা সে যেখান থেকেই হোক। সরকারি খামার, কো-অপারেটিভ, অন্য কোনও প্রতিষ্ঠান বা কোনও দালালের মাধ্যমে। সব মাছচাষিকেই মাছের বীজ স্থানান্তরিত করতে হয়। বীজের উত্স থেকেই হোক বা অন্য কোথাও থেকে। এই দূরত্ব দু-এক কিলোমিটার হতে পারে আবার হাজারও হতে পারে। তাই মাছ-বীজ বা পোনা স্থানান্তরকরণ মাছচাষির কাছে বাধ্যতামূলক।
এই কাজ ভীষণ সাবধানের সঙ্গে করতে হয়। কারণ এই সময় এরা খুব কাতর থাকে। সাধারণত ডিম বা মাছের খুব ছোট অবস্থা অর্থাৎ ধানি বা আঙুলে মাছকেই স্থানান্তরিত করা হয়। এই সময় ক্ষতির অনেক ঝুঁকি থাকে। যেমন --
প্রথমে এই বীজগুলিকে মাটি বা সিমেন্টের তৈরি সংগ্রহস্থলে রাখা হয়। এই সংগ্রহস্থল সেই জল দিয়ে পূর্ণ থাকে যে রকম জলে করে এদের স্থানান্তরিত করা হবে। এই জলের গভীরতা সাধারণত ৫০ – ৭৫ সেমি হয়। ১.৫ মি দৈর্ঘ্য ও ৭৫ সেমি থেকে ১ মি চওড়া হয়ে থাকে। এই স্থান প্রথমে যথোচিত রোগমুক্ত, আগাছা- আবর্জনামুক্ত ও পোকামাকড়মুক্ত জলে পূর্ণ করা হয়। সেই জল যদি উপযুক্ত ঘোলা না হয় তবে তাতে লাল মাটি দিয়ে ঘোলা করা হয়। এখানে ৫/৬ ঘণ্টার জন্য মাছের বীজকে রাখা হয় যেখানে ওরা নতুন পরিবেশে খানিকটা অভ্যস্ত হয়। এ ছাড়া এই ৫/৬ ঘণ্টায় তারা তাদের যে মূল-মূত্র ত্যাগ করে তা এই জলে মিশে যায়। পরবর্তী কালে জল কম দূষিত হয় কারণ এই সময় থেকে তারা খাবার কম পায়। এর পর আস্তে আস্তে সাবধানে এদের স্থানান্তরিত করা হয় বড় মাটির বা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে। এই হাঁড়িতে ৩০ – ৪০ লিটার জল ধরে। এই হাঁড়িতে একই রকম জল দেওয়া হয়। এই জল ঘোলা হওয়ার জন্য বা লাল মাটি দেওয়ার জন্য জলে আলো এবং উত্তাপ ভিতরে পৌছতে পারে না। জল ঠান্ডা থাকে। দূষিত গ্যাস জমতে পারে না। মৃত মাছের বীজ সহজেই ভেসে ওঠে, তাদের বেছে ফেলতে সুবিধা হয়। এই হাঁড়ির চার দিক ভিজে কাপড়ে মুড়ে দেওয়া থাকে। হাঁড়িকে ঠান্ডা রাখার জন্য। এই রকম মাপের হাঁড়িতে প্রায় ৫০০০ ডিম পোনা বা ২০০০ – ৩০০০ ধানি পোনা বা ৬০০ – ১০০০ চারা পোনা বহন করা যেতে পারে। এর পর পরিমাণমতো মাছের বীজ খুব সাবধানে এতে নেওয়া হয় এবং হাঁড়ির মুখ বাতাস প্রবেশ করতে পারে এমন ঢাকা (সাধারণ বাঁশের তৈরি চুপড়ি) দিয়ে ঢাকা হয়। হাত ঢুকিয়ে ক্রমাগত বাইরের অক্সিজেনওয়ালা বাতাস জলের সঙ্গে মেশানো হয়। এর পর এগুলোকে নানা উপায়ে (বাইকে, সাইকেলে, ভ্যানে, গাড়িতে) নিয়ে যাওয়া হয়। এই অবস্থায় ৮ – ১২ ঘণ্টার পথের দূরত্ব পেরোতে খুব অসুবিধা হয় না। আজকাল বেশি বীজ নিয়ে যাওয়ার জন্য বড় বড় অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি ট্যাঙ্কও ব্যবহার করা হচ্ছে। দূর পাল্লায় গাড়ি করে একই নীতিতে নিয়ে যাওয়া হয়। মানুষ পা দিয়ে জলের ভিতর অক্সিজেনযুক্ত বাতাস ঢোকানোর চেষ্টা করে।
আর উন্নত উপায়ে আধুনিক পদ্ধতিতে মৎস্যবীজ পরিবহন করা হয়। এ ক্ষেত্রে পলিথিনের (০.০৬ মিমি) ব্যাগ ব্যবহার করা হয়। এই ব্যাগ সাধারণত ৮২ সেমি X ৬০ সেমি মাপের হয়। অক্সিজেনের অভাবই সব থেকে বেশি ভয়ের কারণ। তাই এই জলে অক্সিজেন যোগ করা হয়ে থাকে। দেখা গেছে জলে ২ পি পি এম-এর বেশি অক্সিজেন থাকলে মাছের মৃত্যু কম হয়।
এই পদ্ধতিতে প্রথমে মৎস্যবীজ হাপায় বা সংরক্ষণস্থলে ৫ / ৬ ঘণ্টা রেখে ধাতস্থ করা হয়। তার পর পলিথিনের ব্যাগ নিশ্ছিদ্র কিনা পরীক্ষা করার পর এগুলোকে একের পর এক মুখ কাটা ক্যানেস্তারা (সাধারণ ১৮ লি কেরোসিন বা সরষের তেলের) টিনের ভিতর ঢোকানো হয়। এই টিনের নীচের দিকে কাগজের টুকরো দেওয়া হয় এবং নল দিয়ে এই ব্যাগে অক্সিজেন সম্পূর্ণ ভরে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হয়। এর পর টিনের চার ধারেও কাগজের টুকরো দিয়ে টিনের মুখ বন্ধ করা হয়। এই কাগজের টুকরো তাপের অপরিবাহী হিসাবে কাজ করে। প্রয়োজনে টিনের বাইরে ভিজে কাপড়ের ব্যবস্থা করা হয়। টিনগুলিকে যথাসম্ভব সব সময় ছায়াতে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। এই ভাবে এদের বহন করে প্রায় ১২ ঘণ্টার রাস্তা সহজেই যাওয়া যায়।
একটি ৮২ সেমি x ৬০ সেমি x ৩০ সেমি আকার জলের পাত্রে মৎস্যবীজ নিয়ে যাওয়া যায় নিম্নরূপ —
চারা পোনার মাপ |
ভারতীয় কার্প |
সাইপ্রিনাস |
গ্রাস কার্প |
সিলভার কার্প |
২ সেমি |
১২০০ |
১০০০ |
৬০০ |
৪০০ |
৩ সেমি |
৬০০ |
৬০০ |
৪০০ |
৩০০ |
৪ সেমি |
৩৫০ |
৪০০ |
৩০০ |
২০০ |
৫ সেমি |
২২৫ |
৩০০ |
২০০ |
১৫০ |
এই মৎস্যবীজ সরাসরি পালন-পুকুরে ছাড়া হয় না। প্রথমে এদের পালন-পুকুরের জলের উপর প্রায় ১ ঘণ্টা ভাসিয়ে রাখা হয় একই উত্তাপে আনার জন্য। পরে আস্তে আস্তে পরিমাণমতো পুকুরে ছাড়া হয়। প্রখর গরম ও ঠান্ডা এড়িয়ে চলা হয়। সাধারণত পড়ন্ত বেলায় ছাড়া হয়।
প্রাপ্তিস্থান : মৎস্য বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
সর্বশেষ সংশোধন করা : 1/20/2020