অন্তর্দেশীয় জলাশয়গুলির জলকেই আমরা মিঠে জল বলে থাকি। ছোট অ্যাকুরিয়াম থেকে শুরু করে আঁতুড় পুকুর, খাল, বিল, নদ, নদী -- সবই মিঠে জলের আধার। তাই এই জলের জলাশয়গুলির রীতিমতো বৈচিত্র্য, ততোধিক বৈচিত্র্যময় মাছের প্রকারভেদ। আকৃতি-প্রকৃতি, খাদ্যাভ্যাস, রঙ-ঢঙ, স্বাদে-গন্ধে তাদের বৈচিত্র্য সীমাহীন। তাদের চাষের পদ্ধতিও ভিন্ন। আমরা মিঠে জলেই মাছ চাষ করে থাকি। এখানে আমাদের পছন্দমতো মাছ উপযুক্ত জলাধারে নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে চাষ করতে পারি। তাই মাছের প্রকৃতি, খাদ্যাভ্যাস, রোগ-ব্যাধি ইত্যাদি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান থাকা দরকার।
খাদ্যের প্রকারের উপর ভিত্তি করে মাছকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়।
সব মাছের যেমন একই রকম খাদ্য পছন্দ নয় তেমনই সব মাছই জলের একই স্তরে থাকে না। বহুল প্রচলিত চাষযোগ্য মাছগুলি জলের বিভিন্ন স্তরে থাকে এবং সেই অনুযায়ী খাবার সংগ্রহ করে।
আমরা আমাদের পুকুর, দিঘি, বিলে যখন সুনির্দিষ্ট মাছের চাষ করি তখন বাজারের কথা ভেবে এবং নিজের লাভের দিকে নজর রেখে সাধারণত রুই, কাতলা, মৃগেল, সাইপ্রিনাস কার্প, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, মাগুর, শিঙি, কৈ, বাটা ইত্যাদি মাছের চাষ করে থাকি। জলাশয়ের জল, খাবার, জলস্থিত অন্যান্য মাছের প্রয়োজনীয় উপাদানের সুষ্ঠু বিবর্তনের জন্য মাছেদের এই অভ্যাস সম্পর্কে আমাদের কিছু ধারণা প্রয়োজন। নদ-নদী, খাল, বিল, দিঘি, পুকুরের জলের তিনটি স্তর কল্পনা করা যেতে পারে।
মানুষ শৌখিনতার গণ্ডি ছেড়ে এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নিজের পুকুরে, বিলে বা ছোট জলাশয়ে মাছের চাষ করতে শিখেছে। তারা জেনেছে একক মাছ চাষের চেয়ে মিশ্র মাছ চাষে অধিক লাভ হয়। জলে মাছের খাদ্য ও প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ সুষ্ঠু ভাবে কাজে লাগানো যায় এই মিশ্র মাছ চাষে। সব প্রাণী ও উদ্ভিদের মতো মাছেরও জাতি-প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের চাহিদা থাকে। তাদের খাদ্যাভ্যাস ও বসবাসের ধরনধারণও আলাদা হয়। এই বিভিন্নতাকে কাজে লাগাতে পারলে প্রকৃতির দান আমরা শুধু বিতরণে এবং ফলন বৃদ্ধিতে কাজে লাগাতে পারি। আমাদের ছোট ও প্রান্তিক মাছচাষি এমনকী বড় মাছচাষিরাও তাঁদের জলাশয়কে পালন-পুকুর বা মজুত-পুকুর হিসাবে কাজে লাগান — অর্থাৎ বাজার থেকে ধানি পোনা বা আঙুলে পোনা কিনে পুকুরে ছাড়েন, তাদের লালনপালন করে পরে বড় হলে প্রয়োজনমতো বিক্রি করেন।
বর্তমানে নিয়ন্ত্রিত প্রজননের সুযোগ হয়েছে। মাছচাষি যাঁরা ডিম ও ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা তৈরি করেন, তাঁরা নিশ্চিত ভাবে জানেন সেই ডিম, ধানি পোনা বা আঙুলে পোনা কোন জাতের এবং কোনও রকম ভাবে মিশ্রণ ছাড়াই মাছ-পালক চাষি তাঁদের পছন্দমতো জাতি-প্রজাতির মাছ এবং প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সংখ্যক মাছ কিনে তাঁদের জলাশয়ে ছাড়তে পারেন। পরিমাপ ও পরিবেশের নিরিখে পুকুরে নির্দিষ্ট সংখ্যক পছন্দের মাছ ছাড়া চাষিদের পক্ষে অনেক সহজ হয়েছে। অধিকাংশ চাষি তাদের পালন ও মজুত-পুকুরে নিজেদের সঙ্গতি ও বাজারের চাহিদার কথা ভেবে রুই, কাতলা, মৃগেল, গ্রাস কার্প, সিলভার কার্প ও আমেরিকান রুই-এর চাষ করেন। সংক্ষেপে তাদের স্বভাব ও খাদ্যাভ্যাস বণর্না করা হল।
কাতলা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। ভারতের উত্তর ভাগের নদ-নদী, সেই সঙ্গে বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, ও মায়ানমার প্রভৃতি দেশে এই মাছ পাওয়া যায়। কাতলা মাছের মাথা দেহের অনুপাতে বেশ বড়। দেহকাণ্ডটি দু’ পাশে চ্যাপ্টা। দেহের রঙ সাদাটে। তবে যে পুকুরে জলজ উদ্ভিদ বেশি ও শ্যাওলা থাকে সেখানে দেহের রঙ কালো হয়। মুখটি বড়, ঠোঁট ও শুঁড়হীন হয়। সমগ্র দেহটি আঁশ দিয়ে ঢাকা থাকে। এরা পুকুরের উপরের অংশে বিচরণ করে। ছোট অবস্থায় প্রাণীখাদ্য কণিকা খায়। মাছ বড় হলে প্রাণী খাদ্যকণা ছাড়াও উদ্ভিদকণা, শ্যাওলা ও খোলোসযুক্ত অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী খায়। বাজারে এদের ভীষণ চাহিদা। এদের যত বড় করা যায় চাহিদা এদের ততই বাড়ে। এবং তুলনামূলক ভাবে লাভ বেশি হয়। নিয়মিত খাবারের জোগানের সঙ্গে পুকুরের পরিচর্যা ও রোগ-পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারলে এই জাতীয় মাছ অনেক বড় হতে পারে। সাধারণ ভাবে ৫-১০ কেজি ৩ – ৭ বছরেই হতে পারে। স্থানীয় পুকুরে বড় করার প্রধান অন্তরায় সামাজিক ব্যধি। মাঝেমধ্যে প্রয়োজনমতো কিছু কিছু করে ধরে বাজারে আনা যায়। দ্বিতীয় বছরেই এদের জননঅঙ্গ পরিপক্কতা লাভ করে। এক কেজি ওজনের মাছে ৭০,০০০ ডিম থাকে। এরা পুকুরে ডিম পাড়ে না, স্রোত যুক্ত জলে ডিম পাড়ে।
রুই মাছ সাধারণত ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, মায়ানমার প্রভৃতি দেশে পাওয়া যায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে যেমন শ্রীলঙ্কা, মরিশাস, জাপান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশেও এদের চাষের চেষ্টা চলছে। এদের দেহ লম্বা ও দ্বিপার্শ্বীয় ভাবে প্রতিসম ও দু’ পাশে চাপা থাকে, মাথাটি ছোট ত্রিকোনাকার এবং মুখের উপরের ঠোঁটে এক জোড়া শুঁড় থাকে। মাথা ও লেজের দিকে ক্রমশ সরু, অনেকটা মাকুর মতো। দেহের পাখনাগুলির বর্ণ লালচে রঙের কিন্তু পেটের দিকের রঙ হালকা সাদা। আবার মাথার সামনের দিক ও পিঠের দিকের রঙ কালচে হয়। রুই মাছ জলের মাঝামাঝি অংশে বিচরণ করে। ছোট অবস্থায় জুপ্ল্যাঙ্কটন বা প্রাণীকণা খায়। বড় হলে এরা উদ্ভিদকণা, প্রাণীকণা, জলজ উদ্ভিদের নরম পাতা খায়। রুই মাছের দু’ বছর বয়সেই জননক্ষমতা হয়। এই সময় পরিণত ডিম্বাশয়ে মোট ২.২৬ লক্ষ থেকে ২.৮ লক্ষ ডিম সৃষ্টি করে। এরা বদ্ধ জলাশয়ে ডিম পাড়ে না। বর্ষাকালে স্রোতযুক্ত মিষ্টি জলে ও প্রজনন পদ্ধতিতে বদ্ধ জলাশয়ে ডিম পাড়ে। অনুকূল পরিবেশে এক বছরে ৯০০ গ্রাম ওজন হয়। এই মাছের বৃদ্ধি কাতলার থেকে একটু কম। ছোট অবস্থায় কাতলার দামের চেয়ে রুই মাছের দাম তুলনায় একটু বেশি। আবার ৩- ৪ কেজি ওজনের উপরে কাতলা মাছের চাহিদা বেশি। তাই রুই মাছকে ছোট থেকেই বিক্রি করা হয় প্রয়োজনমতো।
মৃগেল মাছ ভারতের বিভিন্ন নদনদী ছাড়া বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মায়ানমারে পাওয়া যায়। এদের দেহ সরু, লম্বা ও মাথাটি ছোট। রুপোর ন্যায় সাদা আঁশে দেহ ঢাকা। এরা পুকুরের তলায় থাকে। ছোট অবস্থায় প্রাণীকণা খায়। বড় হলে শ্যাওলা, উদ্ভিদকণা, প্রাণীকণা, জলজ উদ্ভিদ, পুকুরের তলদেশের ক্ষুদ্র ক্ষু্দ্র প্রাণী ও কাদামাটি খায়। এদের দেহের বৃদ্ধি কাতলা ও রুই মাছের তুলনায় কম। মৃগেল মাছ প্রথম অথবা দ্বিতীয় বছরে জননঅঙ্গের পরিপক্কতা লাভ করে। ১-১.৫ কেজি ওজনের মাছের ডিম্বাশয়ে ১.২৮ লক্ষ থেকে ১৯ লক্ষ ডিম পাওয়া সম্ভব। বর্ষাকালে নদীর পার্শ্ববর্তী নিম্ন অঞ্চলে যেখানে প্লাবিত হয় সে সব জায়গায় এরা ডিম ছাড়ে।
বাজারে মৃগেল মাছের চাহিদা রুই কাতলার তুলনায় একটু কম। কিন্তু পুকুরের তলদেশকে ভালো ভাবে কাজে লাগানোর জন্য এই মাছ চাষ খুব উপযোগী। এই মাছ অনেক ছোট অবস্থায় থেকে বাজারে আনা হয়। তাই অপেক্ষাকৃত একটু বেশি সংখ্যায় বাজারে আসার ফলে দামও অন্যান্য মাছের তুলনায় একটু কম হয়।
এদের আদি নিবাস চিন দেশে ও রাশিয়ার আমুর নদীতে। দেহ রুপোলি বর্ণের ছোট ছোট আঁশে ঢাকা। দেহ লম্বা ও চ্যাপ্টা, মাথার সামনের ভাগ সরু ও নীচের চোয়াল সামান্য প্রসারিত। চোখ সাধারণত ছোট। মাথার পরের অংশ থেকে শুরু করে জননছিদ্র পর্যন্ত অঙ্গদেশ খাঁজকাটা। কাতলা মাছের মতো এরাও পুকুরের উপরের স্তরে থাকে, ফলে খাদ্য সংগ্রহের জন্য কাতলা মাছের সঙ্গে এদের সামান্য প্রতিযোগিতা আছে। ছোট অবস্থায় এরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শ্যাওলা খায়। বড় হলে উদ্ভিদকণা এদের প্রধান খাদ্য। এ ছাড়া পচা জলজ উদ্ভিদের অংশও খায়। এদের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল এদের ফুলকায় রেকারের সংখ্যা অনেক হওয়ায় এরা অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিদকণা খেতে পারে যা অন্য মাছে খেতে পারে না। এর ফলে পুকুরে এদের প্রাকৃতিক খাদ্যের অভাব হয় না এবং তাড়াতাড়ি বাড়ে। মোটামুটি দু’ বছরেই এরা প্রজননে সক্ষম হয়ে ওঠে। ৩ – ৮ কেজি ওজনের সিলভার কার্পের ডিম্বাশয়ে ডিমের সংখ্যা ১.৪৫ – ২.০ লক্ষ। এক বছরেই এরা ১.৫ কেজি ওজনের হয়। এরা পুকুরের বদ্ধ জলাশয়ে ডিম ছাড়ে না। তবে প্রণোদিত প্রজনন প্রক্রিয়ায় ডিম পাড়ে। এরা ভীষণ তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায় কিন্তু বাজারে অন্যদের থেকে দাম একটু কম।
গ্রাস কার্প বা ঘেসো রুই মাছের আদি বাসস্থান চিন দেশের নানা নদ-নদী ও রাশিয়াতে অবস্থিত আমূর নদীর অববাহিকা অঞ্চলে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেমন জাপান, থাইল্যান্ড, হংকং, ইজরায়েল, শ্রীলঙ্কা, ভারত প্রভৃতি দেশে চাষ হচ্ছে। ভারতে ১৯৫৯ সালে হংকং থেকে গ্রাস কার্প এনে পরীক্ষামূলক ভাবে চাষ করা হয়। ঘেসো রুই দেখতে মৃগেল মাছের মতো। লম্বাটে দেহ তবে চওড়ায় বেশি নয়। মুখ ছোট এবং উপরের ঠোঁট নীচের তুলনায় একটু লম্বাটে। পিঠটা ধূসর বর্ণের, কিন্তু পেটের রং রুপোলি বর্ণের। এরা পুকুরের মাঝের স্তরে থাকে। ছোট অবস্থায় প্রাণীকণা ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শ্যাওলা খায়। বড় হলে ঝাঁঝি গুড়িপানা, ঘাস, শ্যাওলা প্রভৃতি জলজ উদ্ভিদ এদের প্রধান খাদ্য। পুকুরে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই মাছ বিশেষত উপকারী। এরা নিজেদের দেহের ওজনের দ্বিগুণ খাদ্য গ্রহণ করে। ভারতের জলবায়ুতে পুরুষরা দ্বিতীয় বছরেই জনন ক্রিয়ার উপযুক্ত হয়। ওই সময় জননঅঙ্গ থেকে শুক্রাণু বের হয়, কিন্তু স্ত্রী মাছের তৃতীয় বছর জননঅঙ্গ পরিপক্ক হয়। ৪ – ৭ কেজি ওজনের মাছের ডিম্বাশয়ে ডিমের সংখ্যা ৩ লক্ষ থেকে ৬.২ লক্ষ হয়। মিশ্র চাষে এই মাছ এক বছরে ১.৫ কোজি ওজনের হয়। এরা শাকাহারি। এরা প্রচুর খায় এবং ভীষণ তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পায়। দেখতে মৃগেলের মতো। অনেকে মহাশোল বলে ভুল করে। বাজারে রুই-কাতলার চেয়ে দাম কম।
আমেরিকান রুই বা সাইপ্রিনাস কার্পের আদি নিবাস এশিয়া মহাদেশের উষ্ণ অঞ্চল, চিন, কৃষ্ণসাগর, ক্যাসপিয়ান সাগর ইত্যাদি অঞ্চলে। তবে বর্তমানে পৃথিবীর সর্বত্রই এই মাছ একক বা অন্যান্য মাছের সঙ্গে চাষ করা হয়। এরা পুকুরের তলদেশে থাকে। ছোট অবস্থায় প্রাণীকণা খায়। বড় হলে শ্যাওলা, উদ্ভিদকণা, প্রাণীকণা, পচা জলজ উদ্ভিদ, কেঁচো, গুগলি ও কাদামাটি প্রভৃতি খায়। এক কথায় এরা সর্বভুক। এই মাছের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল খাদ্য সংগ্রহের সময় পুকুরের তলদেশে গর্ত করে; এর ফলে জলজ উদ্ভিদের মূল আলগা হয়ে যায় এবং এই ভাবে পুকুরের জলজ উদ্ভিদকে নিয়ন্ত্রিত করে। এদের বৃদ্ধি খুব ভালো। কিন্তু এদের পেটে প্রচুর চর্বি এবং ডিম হওয়ার কারণে এবং স্বাদ, দাম অপেক্ষাকৃত একটু কম। ছোট মাছের চেয়ে বড় মাছের দাম বেশি।
সুত্রঃ পোর্টাল কনটেন্ট টিম
সর্বশেষ সংশোধন করা : 7/20/2020