পাবদা মাছ একটি বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ। এই মাছ অত্যন- সুস্বাদু এবং জনপ্রিয়। আমাদের দেশে বেশ আগে হাওড়-বাঁওড় -বিলে এই মাছটির পাওয়া যেত। কালের বিবর্তনে প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে এই মাছটি আমাদের দেশ থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে। এই মাছটি উৎপাদন করতে গিয়ে বিভিন্ন হাওড়-বাঁওড় থেকে জীবিত ব্রুড মাছ সংগ্রহ থেকে শুরু করে, ভৌত অবকাঠামো গড়ে তোলা দক্ষ জনবল তৈরি করাসহ ২ বছর ধরে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পোনা উৎপাদন ছিল অত্যন- ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয় বহুল একটি কাজ। ৫% বেশি ব্রুড মাছ বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল। তারপর এই মাছগুলোকে কৃত্রিম খাবারে অভ্যস- করারও ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। কারণ একটি পুষ্টিকর খাবার ছাড়া ব্রুড মাছ কখনও ভালমানের বাচ্চা জন্ম দিতে পারে না। আর সে জন্য এই মাছকে ধীরে ধীরে কৃত্রিম খাবারে অভ্যস- করানো ছিল এক বিরাট সাধনা এবং অভিজ্ঞতাও বটে।
পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, ১০/১১ মাস বয়সে একটি পাবদা মাছ প্রজননে সক্ষম হয়। সুস্থ ও সবল মাছ শতাংশ প্রতি পুরুষ ও স্ত্রী মাছ ৫০ : ৫০ অনুপাতে ৭০/৮০টি মজুদ করে নিয়মিতভাবে দেহের ওজনের ৫% হারে সম্পূরক খাবার দিতে হয়। ৩০% ফিস মিল, ৩০% সরিষার খৈল, ৩০% অটোকুড়া, ১০% ভূষি ও ভিটামিন প্রিমিক্্র সহকারে সম্পূরক খাবার তৈরি করা যায় অথবা বাজারের কৈ মাছের ফিড কাওয়ালেও চলবে।
সাধারণত এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে আগষ্ট মাস পর্যন- পাবদা মাছের প্রজনন কাল। এই সময়ে স্ত্রী মাছের পেটে ডিম ভর্তি থাকে। এছাড়াও পাবদা স্ত্রী মাছের পাখনার কাঁটাগুলোর খাঁজগুলো খুব স্পষ্ট নয় যতটা না পুরুষের ক্ষেত্রে। প্রজনন করার জন্য মাছ ও মাছ বাছাইয়ের জন্য স্ত্রী মাছের উদরে ডিম ভর্তি দেখে পরিপক্কতা সম্পন্ন মাছ বাছাই করে নিতে হয়।
কৃত্রিম প্রজননের জন্য প্রথমে মাছ বাছাই করতে হয়। এক্ষেত্রে সমপরিমাণ পুরুষ ও স্ত্রী মাছ বাছাইয়ের পর পি.জি. দ্রবণের ইনজেকশন দিতে হয়।
প্রথমে ১ সেঃ মিঃ ব্যাস ফাঁক বিশিষ্ট পলিথিন জাতীয় জাল দিয়ে একটি হাপা তৈরি করতে হবে। হাপার মাপ হবে দৈর্ঘ্যে ১২ ফুট প্রস্থে ৪ ফুট। উপরের অংশ খোলা হাপাটিকে এমনভাবে সিস্টার্ণে স্থাপন করতে হবে যেন সম্পূর্ণ হাপাটির নীচের অংশ অর্থাৎ তলার অংশ সিস্টার্ণের তলা থেকে কমপক্ষে ৬ ইঞ্চি উপরে থাকে। এরপর পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে ইনজেকশন করে ১ : ১ অনুপাতে হাপায় ছাড়তে হবে। পরে জলর কৃত্রিম ঝর্ণা দিয়ে স্রোতের সৃষ্টি করতে হবে। এই জাতীয় এক একটি হাপায় ৬০/৭০ জোড়া পাবদা মাছ ইনজেকশন করে ছাড়া যেতে পারে। ইনজেকশন এমন সময়ে করতে হবে যেন মাছগুলো গভীর রাতে ডিম দেয়। কারণ, রাত যত গভীর হবে পাবদা মাছে ডিম দিতে তত স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন- মাছগুলো ডিম দেয়া শেষ করবে। ডিম দেয়া শেষ হলে ব্রুড মাছসহ হাপাটিকে সাবধানের সাথে তুলে নিতে হবে। যেহেতু হাপাটিতে ব্যবহৃত জালটি ১ সেঃ মিঃ ফাঁক বিশিষ্ট তাই মাছগুলো ডিম দেয়ার সাথে সাথে হাপার জালের ফাঁক দিয়ে ডিমগুলো সিস্টার্ণের তলায় পড়ে যাবে। পাবদা মাছের ডিম সামান্য আঠালো থাকা সত্ত্বেও হাপাটি পলিথিন জাতীয় জালের ব্যবহারের জন্য হাপার জালে ডিম আটকাবে না এবং হাপার নীচে পড়ে যাবে অর্থাৎ সিস্টার্ণের তলায় জমা হবে। ব্রুড মাছগুলো সরিয়ে নেয়ার পর সিস্টার্ণের তলায় থেকে সাইফনের মাধ্যমে ডিমগুলোকে একটি প্লাস্টিকের গামলায় সংগ্রহ করা হয়।
এ পদ্ধতিতে পাবদা মাছের ব্রুড মাছগুলোকে পি.জি. হরমোন দিয়ে ইনজেকশন করে সরাসরি সার্কুলার ট্যাংক বা জলর হাউজে ছাড়তে হবে। জলর কৃত্রিম ঝর্ণা দিয়ে স্রোতের সৃষ্টি করতে হবে। বিকেলে পাবদা মাছকে ইনজেকশন দিলে শেষ রাতে ডিম দেয়া শেষ হবে। ডিমগুলো সাকর্ুলারের বা হাউজের মাঝখানে জমা হবে। জমাকৃত ডিমগুলোকে সাইফন পদ্ধতিতে প্লাস্টিক গামলায় একসাথে করতে হবে।
উপরোল্লিখিত ২টি পদ্ধতিতেই পাবদা মাছের ডিম সংগ্রহ করা যায়। তবে হাপা পদ্ধতিতে ডিম সংগ্রহ আমার কাছে বেশি উপযোগী মনে হয়েছে। নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, সিস্টার্ণ পদ্ধতিতে ডিম দেয়ার পর পুরুষ পাবদা মাছ কিছু ডিম খেয়ে ফেলে। সাইফন পদ্ধতিতে প্লাস্টিকের গামলায় ডিমগুলোকে নিয়ে শীটের তৈরি ট্রে অথবা সিমেন্টের তৈরি সিস্টার্ণে রাখতে হবে। ট্রে বা সিস্টার্ণের জলর উচ্চতা হবে ৩-৪ ইঞ্চি। এই অবস্থায় ট্রেতে ছিদ্রযুক্ত পাইপ দিয়ে ঝর্ণার ব্যবস্থা করতে হবে। ২০ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে। বাচ্চা হওয়ার ৩ দিনের মধ্যে ডিম্বথলী শোষিত হয়ে রেণু পোনায় পরিণত হয়। বাচ্চা ফুটে বের হওয়ার ২৪ ঘন্টা পর ডিম্বথলী থাকা অবস্থায় খাবার খেতে পারে। এরা স্বগোত্রভোজী তাই প্রতি ৩ ঘন্টা অন-র অন-র খাবার দিতে হয়। খাদ্য হিসেবে এদের ক্ষুদ্র লাল কেঁচো ভাল করে ব্লেন্ডার করে এক থেকে দুই দিন খাওয়ানোর পর রেণুগুলোকে পুকুরে স্থানান-র করতে হবে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং মৎস্য বিজ্ঞানীগণ পাবদা মাছের পোনা উৎপাদনের উপরও কাজ করছেন। সমসাময়িক সময়ে কিন্তু তাদের উদ্ভাবিত পাবদা মাছের পোনা উৎপাদনের কৌশল আমার কাছে ততটা লাগসই প্রযুক্তি মনে হয়নি। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন যে, পাবদা মাছের বেনুকে ১০/১২ দিন সিস্টার্ণে রেখে ১ ইঞ্চি সাইজ হওয়ার পরে নার্সারিতে স্থানান-রের কথা বলেন। কিন্তু এই পদ্ধতিতে কখনই একজন মৎস্য চাষি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পোনা উৎপাদন করতে পারবে না। কারণ-
বিলুপ্তপ্রায় মাছগুলোর মধ্যে পাবদা অত্যন্ত জনপ্রিয় ও সুস্বাদু মাছ। কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পাবদা মাছ রক্ষার জন্য নিন্মোক্তভাবে প্রজনন কৌশল পরিচালনা সম্ভব।
গুণগতমানসম্পন্ন পোনা উত্পাদনের জন্য প্রজনন ঋতুর ৪ থেকে ৫ মাস আগে থেকেই ব্রুড মাছগুলোকে বিশেষ যত্নের সঙ্গে লালন পালন করা উচিত। এ সময় খাবার হিসেবে ফিশমিল, চালের কুঁড়া, গমের ভূষি, সয়াবিন মিল, সরিষার খৈল, তিলের খৈল, আটা এবং ভিটামিনের প্রিমিক্সের মিশ্রণ মাছের মোট ওজনের ৫ থেকে ৮ ভাগ দিতে হবে। ডিম্বাশয়ের পরিপক্বতা আনায়নের জন্য ভিটামিন ‘ই’ সমৃদ্ধ খাবার ব্যবহারে ভাল ফল পাওয়া যায়। তাছাড়া পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্যের পর্যপ্ততার জন্য নিয়মিত গোবর, ইউরিয়া ও টিএসপি পরিমাণ মতো দিতে হবে।
পাবদা মাছের পুরুষ ব্রুড বাছাইয়ের ক্ষেত্রে পুরুষ মাছটি আকারে তুলনামূলকভাবে স্ত্রী মাছের চেয়ে ছোট। পুরুষ মাছের প্রজনন ঋতুতে পেট চাপা থাকে এবং পুরুষ মাছের বক্ষ পাখনা খাঁজকাটা থাকে। স্ত্রী ব্রুড বাছাইয়ের ক্ষেত্রে স্ত্রী মাছটি আকারে তুলনামূলকভাবে পুরুষ মাছ থেকে বড় হয়। স্ত্রী মাছের প্রজনন ঋতুতে পেট ফোলা ও নরম থাকে এবং স্ত্রী মাছের বক্ষপাখনা তেমন খাঁজকাটা থাকে না।
ইনজেকশন দেয়ার ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা আগে মাছ ধরে সেগুলোকে পুকুরে স্থাপিত গ্লাস নাইলনের হাপাতে স্থানান্তর করা হয়। এ সময় পর্যন্ত অক্সিজেনের জন্য মাছকে ছিদ্রযুক্ত পিভিসি পাইপের সাহায্যে ওপর থেকে অনবরত জলর ফোয়ারা দিতে হবে।
পাবদা মাছের প্রণোদিত প্রজননের জন্য পিজি এবং এইচসিজি দু’টোই ব্যবহার করা যায়। মাছকে মাত্র একবারই ইনজেকশন দিতে হয়। পিজির জন্য সবচেয়ে ভাল মাত্রা হচ্ছে প্রতি কেজি পুরুষ মাছের জন্য ১২.০ মি. গ্রা. এবং প্রতি কেজি স্ত্রী মাছের জন্য ১৮.০ মি.গ্রা। ইনজেকশন দেয়ার সময় ভেজা কাপড় দিয়ে মাথা জড়িয়ে পৃষ্ঠপাখনার নিচে ৪৫ কোণে ইনজেকশন দিতে হবে। ইনজেকশন দেয়ার ৯ থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে হাপাতেই প্রাকৃতিক প্রজনন ক্রিয়ার মাধ্যমে স্ত্রী মাছ ডিম ছাড়ে এবং পুরুষ মাছ শুক্রাণু ছেড়ে ওই ডিম নিষিক্ত করে।
ডিম ছাড়ার পর যত দ্রুত সম্ভব মাছগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে হাপা থেকে সরিয়ে ফেলতে এবং ডিমগুলোকে ট্রেতে স্থানান্তর করতে হবে। এ সময় খেয়াল রাখতে হবে ট্রে ও পুকুরের জলর তাপমাত্র যেন প্রায় একই থাকে। এ জন্য প্রাথমিকভাবে পুকুরের জল ছেঁকে ট্রেতে দেয়া যেতে পারে। ডিম স্থানান্তর করার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেতে ওপর থেকে ছিদ্রযুক্ত পিভিসি পাইপ দিয়ে অনবরত জল সরবরাহ করতে হবে যাতে ডিমগুলো পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায়। এভাবে ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে আসে।
ট্রেতে ডিম থেকে ফোটার ২১ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে রেনু পোনাকে প্রাথমিক খাবার দিতে হবে। প্রাথমিক খাবার হিসেবে টিউবিফিসিড ওয়ার্ম সবচেয়ে ভাল। টিউবিফিসিড ওয়ার্ম ছোট বাটিতে নিয়ে কুচি কুচি করে কেটে দিতে হয়। টিউবিফিসিড ওয়ার্ম না পাওয়া গেলে পুকুর থেকে জুপ্লাংকটন ধরে সুক্ষ্ম ছাকনি দিয়ে ছেঁকে ট্রেতে দিতে হবে।
পোনার চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিন ২ থেকে ৩ বার খাবার দিতে হবে। এভাবে ৬ থেকে ৮ দিন ট্রেতে প্রতিপালন করার পর পোনাগুলোকে সিস্টার্নে স্থানান্তর করতে হবে। ২.৪, ১.৩, ০.৫ ঘনমিটার সাইজের সিস্টার্নে ৩০০ থেকে ৫০০টি পোনা লালন করা যাবে। জলর উচ্চতা ৩০ থেকে ৪০ সে.মি. বজায় রাখতে হবে। সিস্টার্নে ১০ থেকে ১৫ দিন প্রতিপালন করার পর পোনার আকার ২ থেকে ৩ সে.মি হলে পোনাগুলোকে নার্সারি পুকুরে মজুদ করা যাবে।
নার্সারি পুকুরের আয়তন ৩ থেকে ৬ শতাংশ হতে পারে। পুকুর প্রস্তুতির পর শতাংশে ৩০০ থেকে ৪০০টি করে পোনা ছাড়া যেতে পারে। পোনা ছাড়ার আগে ভালভাবে ছোট ফাঁস জাল টেনে পোকামাকড়, সাপব্যাঙ ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে। পোনা সকাল কিংবা সন্ধ্যার আগে ছাড়তে হবে। পোনা ছাড়ার পর প্রতিদিন পোনার দেহ ওজনের ১০ থেকে ২০ ভাগ সম্পূরক খাবার দিতে হবে। প্রতি ১৫ দিন পর পর জাল টেনে মাছার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।
অন্যান্য মাছের মতই পাবদা মাছের চাষ করে লাভজনক উত্পাদন সম্ভব। পাবদা চাষের জন্য ছোট থেকে মাঝারি আকারের পুকুর উত্তম। সার প্রয়োগের ৭ থেকে ১০ দিন পর যখন পুকুরে পর্যাপ্ত প্লাংকটন উত্পাদন হবে তখন পুকুরে প্রতি শতাংশে ১০০ থেকে ১৫০টি হারে ১ থেকে ২ ইঞ্চি সাইজের পাবদার পোনা মজুদ করতে হবে। মাছকে তাদের দেহ ওজনের ৫ থেকে ৮ ভাগ পাঙ্গাসের স্টার্টার-২ খাবার বা হাত মেশিনে প্রস্তুত খাবার দিতে হবে। এভাবে এক বছরে মাছ বাজারজাত উপযোগী আকারে (৬০ থেকে ৮০ গ্রাম) পৌঁছায়
সুত্র: বিকাশপিডিয়া টীম, পশ্চিমবঙ্গ
সর্বশেষ সংশোধন করা : 11/14/2019