কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়া এসিপি প্রদ্যুম্নকে ডক্টর সালুঙ্কে বললেন, “একটা ব্যাপার নিশ্চিত, মাথায় আঘাত করেই খুনটা করা হয়েছে।” শুনে এসিপি-র প্রশ্ন, “মৃতদেহই মিলল না। আর তুমি বুঝে গেলে খুনি কোথায় আঘাত করেছে?” পেশাদার ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ সালুঙ্কের প্রত্যয়ী উত্তর, “ইয়েস বস্। রক্তের দাগ দেখেই বুঝে গিয়েছি।”
টেলি ধারাবাহিক ‘সিআইডি’র সংলাপ বলে মনে হচ্ছে? চরিত্রগুলো ওই ধারাবাহিকেরই। তবে সালুঙ্কের দাবিটিকে আর কাল্পনিক ভাবা উচিত নয়। কারণ খুনের তদন্তের ক্ষেত্রে আগামী দিনে এমন ভাবেই এগোতে পারে কলকাতা পুলিশ। অপেক্ষা শুধু একটি সফটওয়্যারের, যা অপরাধস্থলে লেগে থাকা রক্তের দাগের ধরন বিশ্লেষণ করে খুনের তদন্তে সাহায্য করবে। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অধীনে সেই সফটওয়্যার তৈরির কাজেই এখন ব্যস্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক সমীর বন্দ্যোপাধ্যায় ও গবেষক নবনীতা বসু। যাতে সহযোগিতা করছে কলকাতা পুলিশ।
বিষয়টি নিয়ে এসএসকেএম হাসপাতালের সঙ্গেও প্রাথমিক ভাবে কথাবার্তা হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর। সফটওয়্যারটি তৈরি করতে প্রায় এক কোটি টাকা খরচ হবে বলে জানিয়েছেন সমীরবাবু। লাগবে বেশ কিছুটা সময়ও।
দুই ‘নির্মাতা’র আশা, কোনও অপরাধস্থলে রক্তের দাগ, কোথায় কতটা রক্ত পড়েছে, সে সব বিশ্লেষণ করে অপরাধের দৃশ্য পুনর্নির্মাণে সাহায্য করবে এটি। ঠিক কী ঘটেছিল, নিহত ও আততায়ী ছাড়া ঘটনাস্থলে অন্য কেউ ছিল কি না, তার আঁচও পাওয়া যাবে ওই সফটওয়্যার থেকে। সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান সত্যি না মিথ্যা, তা-ও যাচাই করতে সহায়তা করবে এটি। কিন্তু শুধু রক্তের দাগ থেকে এত কিছু কী ভাবে আন্দাজ করা সম্ভব? গবেষকরা জানাচ্ছেন, রক্তের দাগ বিশ্লেষণ করে যে সব বিষয় নিয়ে অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া যায়, সেগুলি হল: আততায়ী কোথায় দাঁড়িয়ে, কোন দিক থেকে আঘাত করেছে, কত বার আঘাত করেছে, কী ধরনের অস্ত্র দিয়ে আঘাত করেছে, খুনি ও নিহত ছাড়া ঘটনাস্থলে অন্য কেউ থাকলে সে কোথায় ছিল এবং রক্তপাতের সময়ে ওই জায়গায় উপস্থিত ব্যক্তিদের গতিবিধি কী রকম ছিল।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন নবনীতাদেবী। ধরা যাক, কোনও অপরাধস্থলের দেওয়াল বা সিলিংয়ে রক্তের ছিটে পাঁচটি লাইন তৈরি করেছে। সে ক্ষেত্রে অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরি তত্ত্ব অনুযায়ী বুঝতে হবে, আততায়ী চার বার আঘাত করেছে। আবার হয়তো দেখা গেল, কারও জামায় রক্তের দাগ। স্বাভাবিক ভাবে ওই ব্যক্তির উপরেই সন্দেহ তৈরি হওয়ার কথা। কিন্তু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভারী বস্তু দিয়ে আঘাতের ফলে ছিটিয়ে পড়া রক্ত সামনে থাকা খুনির চেয়ে বেশি লাগবে কিছুটা দূরে থাকা অন্য কোনও ব্যক্তির পোশাকে। ওই গবেষকের বক্তব্য, মেঝেতে পড়ে থাকা রক্তের ফোঁটা দেখেও আন্দাজ করা যাবে, আততায়ী ভোঁতা না তীক্ষ্ন, কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছে।
নবনীতাদেবী আরও জানালেন, এই সফটওয়্যার-সংক্রান্ত গবেষণার জন্য শুয়োরের রক্তকে বেছেছেন তাঁরা। কারণ মানবরক্তের সঙ্গে এর অনেকটাই মিল রয়েছে। কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ হওয়ার পাশাপাশি ‘ব্লাড স্টেন প্যার্টান অ্যানালিসিস’ (বিপিএ) নিয়েও জার্মানিতে পড়াশোনা করেছেন তিনি। এই বিষয়ে হাতেকলমে কাজ করেছেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে। সেই অভিজ্ঞতা এখন অনেকটাই কাজে লাগছে তাঁর।
তবে ওই গবেষকের দাবি, এই সফটওয়্যারের কিছু সীমাবদ্ধতাও থাকতে পারে। নবনীতাদেবীর বয়ানে, “ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে খুন করা হলে কিছু সমস্যা হবে। কারণ হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে আশপাশে যে ধরনের রক্তের দাগ দেখতে পাওয়া যায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে একটা ডাবের নীচের অংশ দিয়েও হুবহু একই রকম দাগ তৈরি করা যেতে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে সফটওয়্যারের সাহায্যে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছনো কঠিন। তখন অন্যান্য সূত্রের উপরেই বেশি নির্ভর করতে হবে।” নবনীতাদেবী আরও জানাচ্ছেন, রক্ত যদি কোনও কাপড়ের উপরে পড়ে, তা হলে সহজেই সেই দাগ ধুয়ে ফেলা যাবে। সে ক্ষেত্রেও অন্যান্য সূত্রের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই।
এই বিশেষ সফটওয়্যার তৈরির কাজ কলকাতা পুলিশের আধুনিকীকরণ প্রকল্পের আওতায়। যখন এটি তৈরির কাজ হাতে নেওয়া হয়েছিল, সেই সময়ে এর সঙ্গে কলকাতা পুলিশের তরফে যুক্ত হয়েছিলেন আইপিএস অফিসার দেবাশিস রায়। তখন তিনি কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার। বর্তমানে অবশ্য রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের এডিজি তিনি। তাঁর কথায়, “আমাদের বর্তমান পুলিশি ব্যবস্থায় খুনের তদন্তের ক্ষেত্রে রক্তের দাগের ধরন দেখে এগোনোর পদ্ধতি খুব একটা চালু নয়। তবে এই সফটওয়্যার এক বার তৈরি হয়ে গেলে সেটি গোয়েন্দাদের কাজে অনেকটাই সাহায্য করবে বলে আশা করছি।”
সূত্র : সাবেরী প্রামাণিক, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 11/14/2019