হোর্হে লুই বোর্হেস-এর একটা গল্প ছিল, ‘ফুনেস দ্য মেমোরিয়াস’, তো সেখানে আমরা পাই, ইরেনিয়ো ফুনেসকে, গল্পের নায়ক, এক অর্থে। তার এক আজব স্বপ্নসম জীবদ্দশা ছিল। সে চোখে না দেখেই দেখত পেত, কানে না শুনেই শুনত, আর ভুলে যেতে পারত সমস্তটা, প্রায় সবটাই। অভাবনীয় অবস্থা। কিন্তু আচমকা এক দিন বদলে গেল চিত্রপট। ঘোড়া চড়তে গিয়ে কোনও এক ভাবে ফুনেস পড়ে গেল বাজে ভাবে। এবং তার পরই ফুনেস চোখ দিয়ে দেখতে থাকল, দেখল সে যাবতীয় সব, কান দিয়ে শুনতে শুরু করল, শুনলও সমস্তটা, আর সব চেয়ে বড় কথা, এ সবের আর কিছুই ভুলতে পারল না। অর্থাৎ, সে এ বার থেকে, সব কিছুই মনে রাখতে লাগল, পারলও। এক দিন তো এমনও এল, যখন ফুনেস সারা দিনই কাটিয়ে দিল, ওর আজ অবধি শোনা, দেখাগুলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে রাখতে। কত যে বিশদ ভাবনাপ্রবাহ, কত টুকরো কথা, ছবি অনুভূতি, প্রত্যেক ডিটেল। সে তো এক সময় বলেও উঠেছিল, ‘আমার নিজের মধ্যেই এত স্মৃতি, পৃথিবীর সমস্ত মানুষের স্মৃতির যোগফলের চেয়েও অধিক যা …’ সে আরও বলেছিল, ‘আমার এই স্মৃতিধারণের ক্ষমতা, আদতে এক আস্তাকুঁড় মাত্র…’ ফুনেস তার পর থেকে সারা জীবন এই ইনফিনিটিসম অগাধ স্মৃতির তল পাওয়ার চেষ্টা করে যেত, সেগুলোর যতটা পারা যায় বর্গীকরণ, সেগুলোকে যতটা সম্ভব সহজ সরল করে মনে রাখা যায় ইত্যাদি। ফুনেস শেষে, মারা যায়, স্মৃতির এই ভিড়াক্কারে, অর্থাৎ ফুসফুস সেই স্মৃতির চাপ নিতে না পেরে, হাল ছেড়ে দেয়। ফুনেসকে এই কালে খুব করে মনে পড়ে, কারণ পৃথিবীসুদ্ধু সব্বাই আগামীতে, ফুনেস-এ পরিণত হব, আশঙ্কা। সৌজন্য, এক ‘ডিজিটাল ডার্ক এজ’। অর্থাৎ, আগামীর এক এমন পর্যায়, যেখানে অম্লানবদনে হারিয়ে যাবে সমস্ত ডেটা, প্রত্যেক দিন নিঃসৃত হওয়া এই সমুদ্রসমান তথ্য, কথা, বার্তা, ছবি, ভাবনা, গান, শব্দ, মোট কথা যা যা সব গচ্ছিত রয়েছে হার্ড ড্রাইভে, ইন্টারনেটে, বা ডিজিটাল যে কোনও ফর্মে, তা হঠাৎই এক দিন আর নাগালে পাওয়া যাবে না, ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে না। ‘ডিজিটাল ডার্ক এজ’ বলে এমনই সময়কে। প্রশ্ন এ বার স্বাভাবিক ভাবেই, যে প্রযুক্তি যখন দিনকে দিন ছুঁয়ে ফেলছে স্ট্র্যটোস্ফিয়ার, তখন কোন দুঃখে আচমকা এমন ক্ষণ এসে উপস্থিত হবে? সমস্যা তো সেটাই। মানে, এই দিনকে দিনের প্রযুক্তিগত উন্নতিই তো যত নষ্টের গোড়া। গুগল-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট, ভিন্ট সার্ফ, যাঁকে ইন্টারনেটের জনকও বলা হয়, সম্প্রতি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, যে সাংঘাতিক দ্রুততায় মনুষ্যজাতি প্রযুক্তিগত উন্নতি করে চলেছে, তাতে এক দিন এমন আসবে, যখন বর্তমান কালের ব্যবহৃত কোনও সফটওয়্যার বা ফর্ম্যাট, ভবিষ্যতে আর কাজে লাগবে না, সম্পূর্ণ রূপে তামাদি হয়ে যাবে। সমস্যা হবে তখন। মানে, এই যে এত কিছু কথা-শব্দ ইত্যাদি ডিজিটাল অবতারে, ‘নিরাপদ’ হয়ে থেকে যাচ্ছে, বা আমরা ভাবছি ‘থাকছে’, তা কিন্তু কালের নিয়মে সফটওয়্যার ‘অচল’ হয়ে পড়লে, আর ‘রিড’ করা যাবে না। তার অর্থ করা যাবে না। মানে সিডি, ডিভিডি বা অন্য আরও ডিজিটাল নষ্ট তো হতেই পারে, কিন্তু তার চেয়ে বড় ভয়ের কারণ, মাধ্যম নষ্ট হল না হাতেনাতে, কিন্তু আমরাই বা ভবিষ্যত প্রজন্ম তো বটেই, সফটওয়্যার পুরনো হয়ে গেলে তো বুঝতেই পারব না, সে সিডি-তে আসলে ছিল কী? উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ফ্লপি ডিস্কের কথা, বা অডিও ক্যাসেটের কথা। বছর কিছু আগে কম্পিউটারে কাজ হত ফ্লপির মাধ্যমেই, কিন্তু তার পর সময়ের নিয়মেই, এল নতুন প্রযুক্তি আর ফ্লপি বা ক্যাসেট উঠেই গেল। জায়গা নিল উন্নতমানের এক প্রযুক্তি, সিডি ধরুন। কিন্তু তারও তো সময় হয়ে এল, তাকে কোন দিন সরিয়ে দেবে অন্য কোনও মাধ্যম, আর এমন চলতে থাকলে, অবধারিত ভাবেই, আমরা এক দিন তাল মেলাতে পারব না, আর বর্তমান কালের ইতিহাসও অধরা থেকে হারিয়ে যাবে, ভবিষ্যত ইতিহাসবিদদের কাছে, যাঁরা পাবেন হয়তো এ কালের ধ্বংসস্তূপ থেকে অনেক নিদর্শন, কিন্তু অর্থ করে উঠতে পারবেন না কিছুই।
অবস্থা আরও সঙ্গীন, কারণ আমরা এখন বড়ই অভ্যস্ত, নিজেকে ডিজিটাল-উন্নত করায়। পুরনো কালের মতো, আমরা আর তো নিজ স্মৃতির ফিজিক্যাল কপি রাখি না খুব একটা। ভিন্ট সার্ফ কিন্তু ঠিক এই কম্মোটিকেই আংশিক সমাধান হিসেবে তুলে ধরছেন। মানে যেমন, বিয়ের ফটো অ্যালবামে থাকে না আর, থাকে কম্পিউটারের কোনও ফোল্ডারে, ডিজিটাল কপি হয়ে। কাগজে লেখা চিঠি, ডায়েরি ইত্যাদি লেখা, বা জমিয়ে রাখার চল কমছে, কারণ সেগুলোর স্থায়িত্ব, জীবনকাল নিয়ে শঙ্কা থাকে। কিন্তু উল্টে উন্নতমান, অতএব আরও ‘সুরক্ষিত’ ফুলপ্রুফ এবং এ কালের শেষতম উপায় ভাবা হচ্ছে যেটাকে, তা-ও যখন সম্পূর্ণ ভাবে ক্র্যাশ করবে, তখন স্বভাবতই কোনও কূলকিনারা পাওয়া সম্ভব নয়। নয় কারণ, আপনার কাছে তো তখন আরও উন্নত মানের কোনও প্রযুক্তি। ক্রমাগত আপগ্রেড করে যাওয়ার এই প্রবণতা জরুরি অবশ্যই, কিন্তু এক সময় তো এই দ্রুত গতির এগিয়ে চলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাওয়াও আর সম্ভবপর হবে না। পুরনো সব স্মৃতির রেশ, প্রাক্তন প্রেমিকের মেসেজ হোক, বা বছর পঁচিশেক আগের কোনও অতি জরুরি সরকারি ডকুমেন্ট, চিরতরেই বিলুপ্তির পথ ধরবে। বিপদ তখন। শেষরক্ষার গপ্পো, যুক্তি ও তক্কো। ভিন্ট সার্ফ, এই আশঙ্কার ডিজিটাল ডার্ক এজ থেকে বাঁচতে নিদান দিচ্ছেন প্রথমত সমস্ত কিছুর ফিজিক্যাল কপি করে রাখার। অর্থাৎ বিয়ের ছবি প্রিন্ট করে রাখুন আর কী। তবে তিনি আরও বলছেন, এক ‘ডিজিটাল ভেলাম’-এর কথা। যা কিনা, এক সংগ্রহশালার মতো। তিনি বলছেন, পৃথিবীর যাবতীয় হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারকে এখানে সংরক্ষণ করে রাখা হোক, কোনও এক ‘ক্লাউড’-এর মাধ্যমে। ক্লাউড অর্থাৎ, এক বিশেষ রকমের পরিষেবা, যা কম্পিউটারকে গ্রিড সিস্টেমের মাধ্যমে সংযুক্ত রাখে। অনেকটা ইলেকট্রিক গ্রিডের মতোই। তাঁর মত অনুযায়ী সমস্ত কনটেন্ট, তার অ্যাপ্লিকেশন বা ব্যবহার করার পন্থা ও যে অপারেটিং সিস্টেম দিয়ে সেগুলোর অর্থ করা যায়, সে সবক’টির এক্স-রে ছবি ও বিস্তারিত বিবরণ তুলে রাখা প্রয়োজন। আর দরকার, সে সবকে যতটা পারা যায়, বেশি সময় ধরে সংরক্ষণ করে রাখা। ডিজিটাল ফর্ম্যাটেই হোক না, ওই ক্লাউড মাধ্যমে। ওই যে এক্স-রে ছবি তুলে রাখা হচ্ছে, সঙ্গের ওই বিস্তারিত বিবরণ, তা-ই পরবর্তী কালে, গতকে পুনর্নির্মাণ করতে সাহায্য করবে। আশা। দরকার অনুযায়ী একটি ক্লাউড থেকে আর একটি ক্লাউডেও কনটেন্ট স্থানান্তরিত করা সম্ভব। কিন্তু এখানে অন্তরায় সেই কোড জানা। যে কোড ভবিষ্যতেও একই থাকবে। বা যার অর্থ খুঁজে বের করা যাবে। কিন্তু কোনও এক উপায়ে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন, বা এমন এক পদ্ধতি বের করে ফেলা, যা এই আজ থেকে শুরু করে ভবিষ্যতের প্রযুক্তির সঙ্গেও খাপ খেয়ে যাবে, সব চেয়ে দরকারি। নয়তো, এত ক্লাউড-টাউড কিছুই কাজে আসবে না। কেভিন কেলি’র ‘লাইব্রেরি অব ইউটিলিটি’, লং নাও ফাউন্ডেশনের ‘ম্যানুয়াল ফর সিভিলাইজেশন’ বা ‘ইন্টারনেট আর্কাইভ’ তেমনই কিছু অতি উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা।
কিন্তু এখানেই উঠে আসে প্রশ্ন, যে পরবর্তীর জন্য কোন স্মৃতি প্রয়োজনীয় আর কোনটা তেমন নয়? কোন ছবি, কোন কথা, কোন শব্দ, কোন ভাবনাপ্রবাহ, না জানলে ক্ষতি? আর তা ঠিক করবেই বা কে? এ কাল, ভবিষ্যতের জন্য কোন উপাদান বা নিদর্শন রেখে যাবে, তা-ও কে ঠিক করবে? এক হয় যদি কোনও কেউ বা কোনও এক প্রতিষ্ঠান ‘শেষের সে দিনের’ ঠিক আগের মুহূর্ত অবধি পৃথিবীর যাবতীয় স্মৃতিকে কোনও কিছুতে বন্ধ করে ফেলা যায়, তবে কী থাকছে আর কী থাকছে না, সেই সমস্যা হয় না। কিন্তু সেখানেও থাকে আরও প্রশ্ন, কে সেই প্রতিষ্ঠানকে এক্তিয়ার দিল, আমার কোনও এক ব্যক্তিগত স্মৃতিকে ‘টাইম ক্যাপস্যুল’ গোছের বস্তুটিতে পুরে ফেলার? হতেই তো পারে, যে সে স্মৃতি আমি চাই না, সবাই জানুক? বা ধরুন, ইউ টিউবে দেওয়া প্রিয় বেড়ালের রোদে আহ্লাদিপনা করা ভিডিয়ো, তা কি জরুরি? এ কালের ‘ইতিহাস’ জানতে গেলে পরবর্তী সময়ের কি সেটা জানতেই হবে? প্রশ্ন এখানেও। ইন্টারনেটে ডিজিটাল অবস্থায়, যা কিছু আছে, তার মালিকানা, তার স্বত্ব আদতে কার, সে বিতর্কও কি ওঠে না? ফুনেসের স্মৃতির চাপের এক রকম হিল্লে করার নয় চেষ্টা হল, সংরক্ষণ করার উচিত ব্যবস্থাও, কিন্তু কেউ যদি সে পর্বে হঠাৎ এসে আওয়াজ তোলেন, এ স্মৃতি আমার ব্যক্তিগত, কী অধিকার তাতে জনসাধারণের ? তখন ?
সূত্র : এই সময়, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/14/2020