আর একটি বিষয় নিয়ে শিক্ষকরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে আলোচনা করেছেন সেটি হল ‘প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী’। পুরুলিয়া জেলার কুলবহাল যোগদা সৎসঙ্গ নিম্মবুনিয়াদি বিদ্যালয়ের শিক্ষক অরুণ চন্দ্র মাহাত-র মতে, ‘যে সব ছেলেমেয়ে শিক্ষিত পরিবার থেকে বিদ্যালয়ে আসে, তাদের ক্ষেত্রে কোনও অসুবিধা নেই। কারণ তাদের বাড়ির লোক দু’বছর পর থেকেই ছড়া শেখাতে, কথা বলতে শুরু করে। সমস্যা দেখা দেয় অশিক্ষিত অনুন্নত শ্রেণি থেকে যে সব ছেলেমেয়ে বিদ্যালয়ে আসে। অর্থাৎ প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের নিয়ে।’
অরুণ চন্দ্র মাহাত-র মতোই মন্তব্য মুর্শিদাবাদ জেলার ২৯ চরপিরোজপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিভাস মণ্ডলের :
‘বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। একটি ৬ বা ৭ বছরের শিশুও যখন বিদ্যালয়ে প্রথম আসে, সে কোনও রকম বর্ণপরিচয় নিয়ে আসে না। কারণ তার পরিবারে পড়াশোনার কোনও পরিবেশ নেই। তাই আমরা তাদের হাতে বইগুলি তুলে দিলেও সেগুলি পড়াতে সমর্থ হই না। আমাদেরকে প্রথমে বর্ণ পরিচয় করাতে হয়, তার পরে পাঠ্য পুস্তক পড়াতে হয়।’
এ ক্ষেত্রে শিক্ষকের সময়মতো সার্বিক পাঠ্য অনুশীলনীগুলি সম্পূর্ণ করতে অসুবিধ হয় এবং এ ক্ষেত্রে তিনি প্রথম শ্রেণির পাঠ্যসূচির সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। কিন্তু শিক্ষকের এই মত কতখানি যুক্তি গ্রাহ্য সেটা একটি প্রশ্ন। কারণ, প্রথম শ্রেণির পাঠ্যসূচি তো বর্ণপরিচয় দিয়েই শুরু হয়। শিক্ষকদের কাছ থেকে যে সমস্যাগুলি উঠে এসেছে সেগুলি যে বড় সমস্যা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু যে কোনও শিশুই প্রথম শিক্ষার্থী হয়। বিদ্যালয়ে সব কিছু আগে থেকে শিখে, জেনে ভর্তি হবে এটাও হওয়ার কথা নয়। বিদ্যালয়ে কিছু না জেনে আসাটাই তাদের পক্ষে স্বাভাবিক। শিক্ষকরাই পারেন তাদের সঠিক ভাবে সমস্ত বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত করাতে। ঠিক যেমনটি করে দেখিয়েছেন কোচবিহারের শিক্ষক বরুণ মজুমদার। কোচবিহার জেলার ইন্দ্রনারায়ণ সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক উত্তম সাহার লেখা থেকেও এ রকম কথা জানতে পারা যায় :
‘কোচবিহার জেলার একটি প্রত্যন্ত বিদ্যালয়ে যেখানে প্রায় ৯০% প্রথম প্রজন্মের শিশু সেখানে পত্রিকা প্রকাশ হয়েছিল তাও ছাপার আকারে।’
শিক্ষকদের কথা থেকে এও জানা যায় যে এটি সম্ভব হয়েছে শিক্ষকের চেষ্টায়। তিনি প্রত্যেক শ্রেণির শিশুদের নিয়ে পঠনপাঠনের শেষে বসে গল্প বলার মাধ্যমে শব্দ তৈরি, বাক্য তৈরি, ছড়া শিখিয়েছিলেন। এই সমস্ত বিষয় অবশ্যই বিচার্য। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার পশ্চিম পাঁচগাছিয়া অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুবিকা নাগ (পাল) লেখার গুরুত্ব নিয়ে মন্তব্য করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে কথা বলতে গেলে যা খুব সহজেই বলা যায়, লেখার সময় ভাষা আটকে যায়। তিনি একটি ঘটনার কথাও উল্লেখ করেছেন, ‘গত কালই স্কুলে জয় বললো ‘দিদিমনি তুমি অনেক লেখাও, আর লিখব না।’
এই ঘটনার কথা উল্লেখ করে শিক্ষিকা এটাই বোঝাতে চান যে শিশুদের মনের সাথে, চিন্তাভাবনার সাথে শিক্ষক শিক্ষিকাদেরও তাল মিলিয়ে চলতে হয়।
সূত্র : কলমচারি, প্রতীচী ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০১২
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/27/2020