মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলার কোনও কোনও শিক্ষক বর্ষায় রাস্তাঘাটের দুরবস্থার জন্য তাঁদের বিদ্যালয়ে ওই সময় অনুপস্থিতি বেড়ে যায় বলে উল্লেখ করেছেন। পুরুলিয়া জেলার এক শিক্ষক বিদ্যালয়ে শিক্ষক অপ্রতুলতা শিশুদের অনুপস্থিতির একটা কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পুরুলিয়া জেলারই অন্য এক শিক্ষক দশরথ মান্ডি অনুপস্থিতির কারণ হিসেবে এমন এক সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন, যা আজকের দিনেও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বলে অবাক লাগে। শিশুর বাসস্থান থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব যে আজও কোথাও কোথাও একটি সমস্যা হতে পারে, তা আশ্চর্যের। তিনি লিখেছেন :
‘বিদ্যালয়টির ভৌগোলিক অবস্থান হল তিনটি পাড়ার মাঝামাঝি একটি ফাঁকা মাঠে। এই তিনটি পাড়ার মধ্যে একটি পাড়ার দূরত্ব বিদ্যালয় থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার। ঐ পাড়া থেকে বিদ্যালয়ে আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রীষ্মকালে ও বর্ষাকালে বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। ফলে অভিভাবকগণ বাচ্চাদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিতি সুনিশ্চিত করতে পারে না। তাই ঐ পাড়ায় একটি শিশু শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপিত হলে ভাল হত।’
কোনও কোনও শিক্ষক প্রথম শ্রেণির শিশুদের অনুপস্থিতির সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন। মুর্শিদাবাদ জেলার শিক্ষক সুবিমল ঘোষ লিখেছেন :
‘প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া শিশুদের বেশ কিছু শিশু প্রথম দিকে বিদ্যালয়ে আসতে চায় না বা বাবা মা বিদ্যালয়ে পাঠান না। কারণ হিসেবে দেখা গেছে প্রথমত শিশুরা হঠাৎ করে বাড়ির পরিবেশের বাইরে অচেনা একটা পরিবেশে অপরিচিত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে নিজেদের বিচ্ছিন্ন বোধ করে। দ্বিতীয়ত অনেক বাবা মা ভাবেন তাঁদের ছেলেমেয়েরা ছোট বা দুর্বল প্রকৃতির। বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছি ঠিক আছে, একটু ডাঁইটা হোক (শক্ত) তখন বিদ্যালয়ে পাঠাব।’
যদিও এমন শিক্ষকও পাওয়া গেছে যিনি লিখেছেন অভিভাবকরা মিড ডে মিলের জন্য শিশুর উপযুক্ত বয়স না হওয়া সত্ত্বেও বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
যাই হোক, শিক্ষকদের অভিজ্ঞতার লিখন থেকে এটা পরিষ্কার যে শিশুদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতির ক্ষেত্রে অনেকটাই অগ্রগতি ঘটলেও শিশুদের মধ্যে অনুপস্থিতির সমস্যাটা এখনও গুরুত্বপূর্ণ মাত্রায় রয়েছে এবং শিক্ষকরা যার সমাধান করতে পারছেন না।
শিক্ষকদের লেখাতে এই সমস্যাটা বহু ক্ষেত্রে অভিভাবকদের পিছিয়ে থাকা আর্থিক অবস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে চিহ্নিত হয়েছে। যে সমস্ত শিক্ষকের লেখাতে এর সাথে সামাজিক পরিচিতির যোগ খুঁজে পাওয়া গেছে তাতে দেখা গেছে যে সমস্যাটি মূলত মুসলিম, তফশিলি জনজাতি বা তফশিলি জাতির শিশুদের ক্ষেত্রে বেশি। কিন্তু সমস্যাটির যোগ যে ভাবেই থাক না কেন, তার সমাধান অত্যন্ত জরুরি। নয়তো সকলের জন্য সমান গুণমানের প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য অপূর্ণই থেকে যাবে। এই লেখাগুলিতে পাওয়া শিক্ষকদের সাফল্যের অভিজ্ঞতা অন্যদের কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগানো যায় কি না ভেবে দেখা দরকার। সেই সঙ্গে নীতি সংক্রান্ত যে সব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলি উঠে এসেছে সেগুলিরও মোকাবিলা করতেই হবে।
সূত্র : কলমচারি, প্রতীচী ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০১২
সর্বশেষ সংশোধন করা : 3/28/2019