শিক্ষকদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ উপস্থিতি বাড়ানোর প্রশ্নে কী রকম ভূমিকা পালন করেছে তা শিক্ষকদের বহু লেখা থেকে জানতে পারা যায়। মালদা জেলার শিক্ষক মহঃ হেফজুর রহমান লিখেছেন :
‘হাসানুজ্জামান, তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। বিদ্যালয়ে অনিয়মিত। না আসার কারণ জানতে চাইলে বলে, রান্নার জ্বালানির জন্য আমপাতা কুড়াতে, বাবার জন্য মাঠে খাবার দিতে পাঠায় তার মা। তার সাথে দেখা করলাম। মা বলল, ছেলেকে পাঠালেও যায় না। পাশের বাড়ির এক মা বললেন, ছেলের কথাই ঠিক। হাসানুজ্জামানের মতো আরও অনেকে বিদ্যালয়ে অনিয়মিত। ভাবলাম আর হবে না। এই দরিদ্র সমাজের শিশুদের অন্তরায় দারিদ্র। পরে আবার ভাবলাম সব মায়েদের নিয়ে সভা করলে আশাকরি ফল পাব। সভা করলাম। শিশুদের ভাল শিক্ষার জন্য মায়েদের ভূমিকা নিয়ে মায়েদের দিয়েই আলোচনা করালাম। অভূতপূর্ব দিক নির্দেশনা পেলাম। পাড়াভিত্তিক কিছু মাকে দায়িত্ব দিলাম। আশাতীত সাফল্য পেলাম।’
উত্তর দিনাজ পুরের এক শিক্ষক লিখেছেন :
‘শিক্ষকতার কাজে যোগ দিয়ে (২০০৩) ... চতুর্থ শ্রেণির দায়িত্ব পড়ল। প্রায় ৭০ শতাংশ ছেলেমেয়ে নিজের নামটুকুও লিখতে পারে না।... (প্রধান শিক্ষক) উত্তর দিলেন মাত্র ৩ জন শিক্ষক ছিলাম, এক জন তো আসেই না, অন্য কাজে ব্যস্ত; দু’জন মিলে এত জনকে সামলানো যায় না। এ ছাড়া ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই দু/তিন মাস করে দিল্লি, বোম্বে চলে যায়; শেখানো শুরু করেও কোনও লাভ পাওয়া যায় না। প্রধান শিক্ষকের কথায় আশ্বস্ত হতে পারলাম না... বেরিয়ে পড়লাম গ্রামের বাড়ি বাড়ি। অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলা, পরিচয় দেওয়া, শিশুকে বিদ্যালয়ে পাঠাবার কাতর আবেদন। গ্রামের জীবনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানের ডাক আসতে শুরু করল। ... প্রায় ৩ মাস বাড়ি বাড়ি যাওয়া, ছোটখাটো সমস্যার সমাধান, হাসপাতালে, থানায় দৌড়ে যাওয়া। বিদ্যালয়ে অন্য নতুন শিক্ষককে দায়িত্ব দিয়ে গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে জনসংযোগ, ভোটে দাঁড়াবার জন্য নয়, শিশুকে অভিভাবককে বিদ্যালয়মুখী করার জন্য। গ্রামের রাস্তায় বেরোলেই ডাক আসত, লয়া মাস্টার খান যাচ্ছে। পথ চলতি শিশুকে অভিভাবকের তাড়া, যা যা তাড়াতাড়ি ইস্কুলে যা। দু’ মাসের পরিবর্তনের ছোঁয়ায় বিদ্যালয়ের গড় উপস্থিতি ২০০/২২০-তে পৌঁছাল।’
এই অভিজ্ঞতার মধ্যে যদিও কোনও কোনও শিক্ষকদের অবহেলার কথাও লেখাতে উঠে এসেছে, কিন্তু শিশুদের উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য শিক্ষকরা নিজেদেরকে প্রণোদনার কোন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তার প্রমাণও এই লেখাগুলি থেকে মেলে।
সূত্র : কলমচারি, প্রতীচী ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০১২
সর্বশেষ সংশোধন করা : 5/9/2020