সাম্প্রতিক কালে একটি বহুল চর্চিত বিষয় হল পাশফেল প্রথা। কিন্তু আমাদের কর্মশালাগুলিতে মাত্র ৯ জন শিক্ষক এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এবং ৯ জনই পাশফেল প্রথা তুলে দেওয়া বা নো ডিটেশন পলিসির বিপক্ষে কথা বলেছেন। তাঁদের কথা অনুযায়ী যে শিশু কিছুই শিখতে পারছে না, নো ডিটেনশন পলিসি প্রয়োগ করে তাকে অন্য শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করায় হয়তো অভিভাবকেরা খুশি হচ্ছেন আসলে পরবর্তী কালে সমস্যায় পড়ছে এই শিশুগুলি। যেমন মালদার সোবা হালদার লিখছেন :
‘যে গ্রামের লোকেরা নিরক্ষর সেই গ্রামের ছেলেমেয়েরা যখন বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে আসে তখন তারা কিছুই জানে না বা বাড়িতে তাদের কেউ শেখানোর থাকে না। এমতাবস্থায় প্রথম শ্রেণির যে সিলেবাস সেটা আমরা শেষ করতে পারি না, তাতে শিশুর যে ঘাটতি থেকে যায় এবং নো ডিটেনশন পলিসির জন্য সেই শিশুকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে তুলে দিতে হয়। এখানে শিশুটি পড়াশোনায় দুর্বল অবস্থায় দ্বিতীয় শ্রেণির পঠনপাঠন ঠিকমতো করতে পারে না। আবার দ্বিতীয় শ্রেণির শেষ না করেই তাকে তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করতে হয়। কাজেই দেখা যাচ্ছে প্রথম থেকে দুর্বল হতে হতে সে এক সময় তার লেখাপড়া ছেড়ে দেয়।’
বারুইপুরের প্রদ্যুৎ কুমার ঘোষের লেখায় একই রকম সুর — নো ডিটেনশন পদ্ধতির ফলে শিশু পরবর্তী শ্রেণিতে যায় বটে কিন্তু আগের শ্রেণির বেশির ভাগটাই তার কাছে অধরা থেকে যায়। পরবর্তী শ্রেণিগুলিতে অবস্থা একই চলতে থাকে।’
অর্থাৎ, এই বিষয়টি নিয়ে যতটা সামাজিক স্তরে আলোচনা হওয়া দরকার সেটা কিন্তু হচ্ছে না। শিক্ষকদের অংশবিশেষ এখনও যে মনে করছেন পাশফেল প্রথা তুলে দিয়ে সমস্যা হয়েছে সেটা তাঁরা তাঁদের নিজস্ব অবস্থান থেকে বলছেন। এই অবস্থানটা কী রকম? একটা হচ্ছে প্রথার অনুসরণ — যা চলে আসছে তাই ঠিক, এবং নতুন কিছুকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে অনীহা। আবার অন্যটা হচ্ছে বাস্তব পরিস্থিতি, যেখানে শিশুদের একাংশ নানা কারণেই যতটা দরকার তা শিখে উঠতে পারছে না। ফলে মনে করা হচ্ছে না শিখে উপরের ক্লাসে যাওয়ার চেয়ে নীচের ক্লাসে থেকে যাওয়া ভালো। বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রথার যে সংঘাত সেটা আরও জোরালো হয় শিক্ষকের অনেকেরই কর্মস্থলে ন্যূনতম পরিকাঠামো না থাকার মধ্য দিয়ে। আবার এর সঙ্গে যোগ হয় নতুন কোনও কিছু প্রচলন করার সময় সেটা কেন করা হল না তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা না করেই হুকুম জারি করা। একটা শিশু ক্লাসে আসে পড়বার জন্য — ক্লাসে যতটুকু পড়ানোর কথা সেটা করতে পারলে কোনও শিশুর যে ফেল করার কথা নয় তা আমরা পৃথিবীর নানা দেশের অভিজ্ঞতা থেকে জানি। কিন্তু সমস্যা হল, আমাদের এক দিকে যেমন যথেষ্ট পরিকাঠামো থাকে না, তেমনি থাকে না শিক্ষাবিজ্ঞান নিয়ে গভীর আলোচনা। এটা থেকেই কোনও শিক্ষক শিশুদের অধিকারের দিকটি বিস্মৃত হয়ে, তাদের উপর একটা অন্যায় প্রথা চাপিয়ে রাখার দাবি জানান। অবশ্যই এটা যে শিক্ষকের দোষ ততটা নয় যতটা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের।
সূত্র : কলমচারি, প্রতীচী ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০১২
সর্বশেষ সংশোধন করা : 7/21/2020