আলিপুরদুয়ারের অরূপবরুণ দত্তের মতো আরও অনেক শিক্ষক আছেন যাঁরা নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছেন ঐ রাভা, রাজবংশী বা সাদরি ভাষাভাষী শিশুগুলির মধ্যে শিক্ষার আলো পৌছে দেওয়ার। ভাষার কারণে যাতে তারা পিছিয়ে না যায়। ভাষার ক্ষেত্রে আর একটি সমস্যা যা শিক্ষকেরা প্রায়ই মোকাবিলা করে থাকেন তা হল ভাষায় আঞ্চলিকতার প্রাধান্য। অর্থাৎ মুল ভাষার সাথে যথেষ্ট সামঞ্জস্য বহনকারী আরও কিছু ভাষা। সে ক্ষেত্রে শিশুরা অনেক সময় তাদের রোজকার ব্যবহৃত ভাষার সাথে বইয়ের ভাষার মিল খুঁজে পায় না। যেমন মালদার বেশ কিছু বিদ্যালয়ে এবং রাজগঞ্জের কিছু বিদ্যালয়ে শিশুদের মধ্যে যথাক্রমে খোট্টা ও সূর্যপুরী ভাষার আধিক্য। এবং শিক্ষকদের লেখা অনুযায়ী দু’টি ভাষাই আসলে বাংলা ভাষারই আঞ্চলিক রূপ। যেমন কোচবিহারের বাবলু সরকার লিখছেন, যে বিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা করেন সেটি প্রত্যন্ত গ্রামে। যেখানে শহরের পরিবেশের কোনও ছাপ নেই। স্বাভাবতই সেখানকার শিশুরা একদম গ্রামের চলতি ভাষাতেই কথা বলে। প্রথম প্রথম তিনি শিশুদের ভাষা একেবারেই বুঝতেন না। পরবর্তীকালে শিশুগুলির সাথে কথা বলে, বন্ধুর মতো মিশে এই সমস্যাটি অনেকাংশে দূর করেন।
ছোট ছোট শিশু যদি তার শিক্ষকের ভাষা বুঝতে না পারে, কিছুতেই তারা ঐ শিক্ষকের সাথে সহজ হতে পারে না। প্রতিটি শিক্ষকের লেখাতে একই অভিজ্ঞতা। মালদার কালিদিঘি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক উপিন মুর্মু লিখছেন :
‘আমি উপলব্ধি করেছি ছেলেমেয়েরা নিজেদের গৃহ পরিবেশের সঙ্গে বিদ্যালয় পরিবেশ মানিয়ে নিতে পারে না কারণ যে হেতু তারা তাদের গৃহ পরিবেশে বাবা, মা বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে মাতৃভাষায় (আদিবাসী) কথোপকথন করে, বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা বোঝা তাদের পক্ষে বেশ কঠিনই হয়। আমাদের বিদ্যালয়ে দেখেছি যে হেতু আমি একজন আদিবাসী শিক্ষক, যখন আদিবাসী ভাষায় তাদের সঙ্গে কথা বলি, তারা উৎসাহ পায়। স্বতস্ফূর্ত ভাবে উত্তর দেয়, আগ্রহ বাড়ে কিন্তু অন্যান্য শিক্ষকশিক্ষিকার কাছে তারা ভয় পায়। ফলে অন্যান্য শিক্ষকশিক্ষিকা শিশুদের কাছে ঠিক সাড়া পান না।’
শিক্ষকেরা নিজেরাই এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে গেলেও সরকারের অনেক কিছু করার জায়গা রয়েছে এই ক্ষেত্রে। যারা উৎসাহ নিয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু ভাষার সমস্যার জন্য কিছুই বুঝতে না পেরে হীনমন্যতার শিকার হচ্ছে --- তাদের সাহায্যের জন্য অন্য সমস্যাগুলিকে ছেড়ে দিয়ে শুধুমাত্র এই ছোট ছোট শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে, শীঘ্রই পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
সূত্র : কলমচারি, প্রতীচী ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০১২
সর্বশেষ সংশোধন করা : 11/17/2019