আমার শিক্ষকতা জীবনের শুরু একটি দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে। আমার বাবা এক জন প্রাথমিক শিক্ষক ছিলেন। তাঁর অকাল মৃত্যু আমাকে ছাত্র থেকে শিক্ষকে পরিণত করে।
শিক্ষকতা জীবনের শুরুতেই আমি যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই তা মুর্শিদাবাদ জেলার সামগ্রিক সমস্যা। ভৌগোলিক অবস্থান ও ঐতিহাসিক কারণে মুর্শিদাবাদ ভূমিহীন কৃষক অধ্যুষিত জেলা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তে আসা শতকরা ৬৫ শতাংশ শিশু দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী পরিবার থেকে আসে। সেই সময় (১৯৮৭) ১০ বছর বয়সি বেশির ভাগ শিশু হয় পারিবারিক কাজে বা শিশু শ্রমিক হিসাবে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত হয়ে যেত। তারা নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসত না। অভিভাবকগণ তাদের শিশুদের শিক্ষার আঙিনায় আনতে চাইলেও অর্থনৈতিক সমস্যা তাদের ইচ্ছাপূরণে প্রাচীর হয়ে দেখা দিত। পরবর্তী কালে আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি, সর্বশিক্ষা অভিযান মিড ডে মিলের প্রবর্তন, পাঠ্যক্রমের আধুনিকীকরণ প্রভৃতি কারণে সামগ্রিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে।
বর্তমানে ৫ + বয়সি সকল শিশুই বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় এবং প্রায় ৯৮ শতাংশ শিশু প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করা অনেক শিশুই তাদের কাম্য সামর্থ্যে পৌঁছতে পারছে না বা প্রাসঙ্গিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করার পর পড়া ছেড়ে দিচ্ছে।
এ ক্ষেত্রে আমি যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি সেগুলি হল — প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিশুদের বেশ কিছু শিশু প্রথম দিকে বিদ্যালয়ে আসতে চায় না বা বাবা মা বিদ্যালয়ে পাঠান না। কারণ হিসাবে দেখা যাচ্ছে প্রথমত, শিশুরা হঠাৎ করে বাড়ির পরিবেশের বাইরে অচেনা একটা পরিবেশে অপরিচিত শিক্ষক শিক্ষিকাদের মধ্যে নিজেদের বিচ্ছন্ন বোধ করে। দ্বিতীয়ত, অনেক বাবা মা ভাবেন তাঁদের ছেলেমেয়ে ছোট বা দুর্বল প্রকৃতির। বিদ্যালয়ে ভর্তি করেছি ঠিক আছে, একটু ডাঁটো হোক তখন বিদ্যালয়ে পাঠাব। এর ফলে ঐ সব শিশু তাদের প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম ধাপ অর্থাৎ বর্ণপরিচয়, সংখ্যা পরিচয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে (যে হেতু ঐ সকল শিশু তাদের গৃহ পরিবেশে বর্ণপরিচয় বা ঐ ধরনের শিখনের কোনও সুযোগ পায় না)। এবং যখন তারা বিদ্যালয়ে আসা শুরু করে তখন তারা অন্যদের অর্থাৎ নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসা শিশুদের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে না পেরে বিদ্যালয়ে একেবারেই আসতে চায় না।
সূত্র : কলমচারি, প্রতীচী ইনস্টিটিউট, ফেব্রুয়ারি ২০১২
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/23/2020