জন্ম ১৮৮৪, মৃত্যু ১৯১৫। অবিস্মরণীয় সেই বারুদবালিকার উদয় ঊনিশ শতকের অস্তলগ্নে। মায়ের পেশার অনিবার্য অনুসরণের জন্য সাধারণ এক বারাঙ্গনা-কন্যার যতটুকু রূপ-গুণ-শিক্ষার দরকার ছিল, বালিকার অর্জন ছিল তার চাইতে অনেক বেশি। মায়াবী লাবণ্য, অসাধারণ গানের গলা এবং পড়াশোনায় চমক লাগানো নৈপুণ্য (ঝামাপুকুর এএম গার্লস স্কুল থেকে মধ্যবাংলা পরীক্ষায় দারুণ নম্বর পেয়ে পাশ)!
কিন্তু সমস্ত হিসেব নিজস্ব জেদে উল্টে দিয়ে দিব্যাঙ্গনা সেই কিশোরী এসে দাঁড়াল অচেনা নাট্যাঙ্গনাদের মধ্যে। মায়ের আশা কিংবা বাসা থেকে চিরকালের মতো বার হয়ে এসে। প্রথমে ‘ক্লাসিক’, পরে ‘মিনার্ভা’, মাঝে মেছুয়াবাজারে রামকৃষ্ণ রায়ের তৈরি ‘গেইটি’ থিয়েটার। উপেক্ষার আর অনাদরের সেই ট্রায়াল পর্ব শেষে চোরাবাগানের ‘এম্প্রেস’ থিয়েটারে এসে নটী সুশীলাবালার ইচ্ছাপূরণের সূচনা। আচার্য অর্ধেন্দুশেখরের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সুশীলা পেয়েছিল সে সময়ের সেরা অভিনেত্রী তিনকড়ির স্নেহ, সখ্য আর নিঃস্বার্থ সমর্থন! তিনকড়ি সুশীলাকে নিয়ে গিয়েছিলেন গিরিশচন্দ্রের কাছে। গিরিশচন্দ্র তত দিনে স্টার থিয়েটার ছেড়ে রাজসাহীর বোদালিয়ায় একটি সাধারণ রঙ্গালয় স্থাপনের দায়িত্ব নিয়েছেন। গিরিশের পরিচালনায় বোদালিয়ার ‘মার্ভেল থিয়েটার’-এ সুশীলাবালা সর্বার্থেই পাকা অভিনেত্রী হয়ে উঠল। বোদালিয়া থেকে ফিরে আবার ক্লাসিক থিয়েটারে, তার পর আবার মিনার্ভায়। দুই থিয়েটারেই জনমোহিনী আকর্ষণ সুশীলাবালার গান আর অভিনয়। গিরিশচন্দ্রের ‘বলিদান’ নাটকে ‘জোবি’র ভূমিকায়, ‘সিরাজদৌল্লা’ নাটকে লুত্ফার ভূমিকায়, ‘মীরকাসিম’ নাটকে বেগমের ভূমিকায় তার অভিনয় অগণিত দর্শক-সমালোচকদের বিস্মিত বিমুগ্ধ করে দিল। সুশীলাবালা উদ্দীপক অভিনয়ের পাশাপাশি মধুর দরাজ গলায় তাঁর গান মুগ্ধ করত সকলকে। এত সব প্রাপ্তি আর স্বীকৃতির পাশাপাশি সুশীলাবালাকে নিয়ে কিন্তু গুণমুগ্ধদের তরফে সমালোচনা কম হয়নি। ৩১ বছরের ছোট্টো পরমায়ুতে অভিনয় জীবনের প্রাথমিক পাঠের পর প্রবল খ্যাতি আর ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তার মুখে সে বার বার ভুল ঠিকানায় গিয়েছে, ভুল নাটক করেছে, ভুল উদ্যোগের সঙ্গী হয়েছে;--- এক অস্থির একগুঁয়েমিতে অকিঞ্চিত্কর প্রযোজনা আর প্রযোজকের নীরক্ত উদ্যোগগুলোর দায় একা কাঁধে নিয়েছে। শ্রীপুরের জমিদার নরেন্দ্রনাথ সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ককে কেরিয়ারের থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে অকালে ঝড়ে গিয়েছেন এই বিরল প্রতিভা। কোনও দিন সুশীলাবালা তার একমুখী প্রেমকে কলুষিত করেনি, কোনও দিন অবিশ্বস্ত হয়নি নরেন্দ্রনাথের প্রতি। মিনার্ভার দুরবস্থায় নরেন্দ্রনাথ শুধুমাত্র সুশীলাবালাকে পুরোপুরি দখলের লোভে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে মিনার্ভার দায়ভার নিলেন, গিরিশচন্দ্রকে সামনে রেখে তার অস্থির মানসিকতা কিংবা উচ্চাশার ঘুড়ি উড়ছে তখন! তত দিনে সুশীলাবালা নরেন্দ্রনাথকে ঘর বাঁধতে রাজি করিয়েছে। কিন্তু এই নরেন্দ্রনাথই আরও বড় উচ্চাশায় আর অস্থিরতায় গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে এক দিন তাঁর এগ্রিমেন্ট বাতিল করে দিলেন। গিরিশবাবু মিনার্ভা ছেড়ে গেলেন, কিন্তু সুশীলাবালা নরেন্দ্রনাথকে ছেড়ে যায় কেমন করে? গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে প্রায় সব গুণী শিল্পীই মিনার্ভা ছেড়ে গেছেন। একের পর এক নিজের জলসা বা প্রযোজনায় নীরক্ত নাটক নামাচ্ছেন নরেন্দ্রনাথ, সঙ্গে একমাত্র আকর্ষণ সুশীলাবালা। সুশীলার নামে দর্শক আসেন, শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে ফিরে যান। অজস্র দেনায় আচ্ছন্ন নরেন্দ্রনাথ নিজেকে শেষ পর্যন্ত দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন। সর্বস্বহারা নরেন্দ্রনাথকে নিয়ে একাই সংসারযুদ্ধ শুরু করলেন সুশীলাবালা, সকলের চোখের আড়ালে এক বীরাঙ্গনার লড়াই। ১৯১৪-র ২৪ জুন পর্যন্ত সুশীলাবালা এক নাগাড়ে কাজ করে চলেছিল, তত দিনে সুশীলা সন্তানসম্ভবা। প্রবল পরিশ্রমে, নরেন্দ্রনাথকে সুস্থ আর স্বচ্ছল রাখার একরোখা প্রতীক্ষায় সে ভুলে গেল যে তার নিজের শরীরে নানা রোগের উপসর্গ। নরেন্দ্রনাথ সুশীলাবালার সঙ্গে ঘর করেছেন, কিন্তু তাঁকে ঘরনির ন্যায্য সম্মান দেননি কোনও দিন। সম্ভবত সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারটিতেও তার প্রবল আপত্তি ছিল। মৃত সন্তান প্রসবের পর অসুস্থ দুর্বল সুশীলাবালা কিন্তু ডাক্তারদের নিষেধ উপেক্ষা করেই আবার স্টারে নিয়মিত অভিনয় শুরু করলেন। যে কোনও মূল্যে নরেন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ধরে রাখার সে এক আত্মঘাতী প্রয়াস। ১৯১৫-র ৩ জানুয়ারি সুশীলাবালার ৩১ বছরের জীবন যখন শেষ হয়ে গেল, নরেন্দ্রনাথ তার আগে থেকেই নিরুদ্দেশ। সুশীলাবালার মৃত্যু নিয়ে রহস্য এখনও মেটেনি। অধিকাংশই বলেন, আত্মহত্যা, কেউ কেউ বলেন রোগে মৃত্যু। তাঁর অকালপ্রয়াণের পর জনপ্রিয় অভিনেত্রীর শবযাত্রায় অনুগমন করেছিলেন অসংখ্য মানুষ, বহু অনুরাগী ভদ্রজন! সে যুগে এমন সুভদ্র শবযাত্রার দৃশ্য বিরল ছিল। সে দিন সুশীলার উদ্দেশে রচিত হয়েছিল বেশ কিছু সমর্থ শোক-কবিতা। সে যুগে সাধারণ রঙ্গালয়ের কোনও অভিনেত্রীর ভাগ্যে এমন দুর্লভ সম্মানপ্রাপ্তি ঘটেনি।
শুধু অভিনয় প্রতিভা আর প্রেমের জন্য আত্মত্যাগ নয়, সুশীলাবালাকে মনে রাখতে হবে অন্য একটি কারণেও। ১৯১২-র ৯ ফেব্রুয়ারি খবর এল গিরিশচন্দ্রের প্রয়াণ ঘটেছে। সুশীলাবালা তখনও অগ্রগণ্যা অভিনেত্রী। গিরিশচন্দ্রের শিক্ষণ আর আশীর্বাদধন্যা সব অভিনেত্রীদের সম্মিলিত করে চিরপ্রশান্ত সুশীলার সেই প্রবল শোকে অন্য চেহারা, তখন সে প্রতিবাদিনী নেত্রী। কারণ গিরিশ-প্রয়াণের পর কলকাতার টাউন হলে সারদাচরণ মিত্র, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা বর্ধমানের রাজা বিজয়চাঁদ মহতাবের সভাপতিত্বে যে বিরাট শোকসভার ডাক দিলেন সেখানে মৃতের প্রতি সম্মান আর শুদ্ধতার অজুহাতে অভিনেত্রীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়েছিল। প্রতিবাদে সুশীলাবালার নেতৃত্বে অভিনেত্রীরা তাদের শিক্ষক ও পিতৃতুল্য গিরিশচন্দ্রের প্রতি প্রকাশ্যে শোক প্রকাশের অধিকার দাবি করেছিলেন। দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। প্রতি বার কলকাতার সেই নীতিবাগীশদের প্রতি ঘৃণায় আর ক্ষোভে ফুঁসে ওঠা সুশীলাবালার নেতৃত্বে শেষ পর্যন্ত ১৮ সেপ্টেম্বর অভিনেত্রীদের তরফে একটি উল্লেখযোগ্য শোকসভা হয় স্টার রঙ্গমঞ্চে। সেই প্রেক্ষিতেই সুশীলাবালার ক্ষুব্ধ জিজ্ঞাসা ছিল--- ‘নারীকে বেশ্যা বানায় যাঁরা তাঁরা বেশ্যাকে ঘৃণা করে কোন মুখে?’ শোকসভায় সুশীলাবালা বলেছিলেন, ‘... পতিতা আমরা, সমাজ বর্জিতা বটে --- কিন্তু আমরা মানুষ। ... প্রিয়জন বিরহে যদি ক্রন্দনের অধিকার থাকে, ... বুকফাটা হাহাকারে যদি দোষ না থাকে তবে আমাদের শোক দূষণীয় হইবে কেন?’ সে যুগে অভিনেত্রীদের এই প্রতিস্পর্ধা ঐতিহাসিক ভাবে একটি বিরল ঘটনা।
সূত্র : রবিবারোয়ারি, এই সময়, ৮ মার্চ ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/28/2020