তেরপলের তৈরি ১২ /১২ ফুটের তাঁবু। সামনে বসে বছর ত্রিশের একটি নেপালি মেয়ে রোদে চুল শুকোচ্ছে। আড়াই-তিন বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে এদিক-
ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে, খুঁটিতে বাঁধা তাঁবুর দড়ি ধরে ক্রমশই চেষ্টা চালাচ্ছে ডিগবাজি খাওয়ার। হিন্দিভাষী সাবিনা প্রায় তেইশ বছর হল সার্কাসে খেলা দেখাচ্ছে। নেপালের হিটড়া অঞ্চলে সে থাকত তার পরিবারের সঙ্গে --- ‘এক দিন আমার বড়মাসির বাড়ি ঘুরতে গিয়ে দেখি মাসির ছেলে ১৬ জন মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে, ভাই বলল ওদের ভারতের সার্কাসে নিয়ে যাচ্ছি। আমিও সার্কাসে আসার জন্য জেদ ধরলাম। এখানে এসে প্রথম দু-এক বছর খুব খারাপ লাগত, কাঁদতাম, বাড়ির কথা মনে পড়ত। বড় হলাম, সব ভুলতে লাগলাম। সার্কাসেই এক জনকে ভালো লেগে গেল, সে এসেছিল বিহার থেকে দড়ির খেলা দেখাত, ওর সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়। আমার শ্বশুরবাড়ি বিহারে, তিন ছেলেমেয়ে বিহারে আমার শাশুড়ি আর ননদের কাছে থাকে। ওরা সেখানে স্কুলে পড়াশোনা করছে। আর আমার এই ছোট মেয়ের বয়স তিন বছর। ও এত দুরন্ত ওকে ওখানে সামলানোর কেউ নেই, ছ’বছর হয়ে গেলে বিহারে পাঠিয়ে দেবো। আমি চাই না সার্কাসের এই জীবনে আমার ছেলেমেয়েরাও আসুক। ওরা পড়াশোনা করে আরও বড় হোক, ভালো কাজ করুক। সার্কাসের এই জীবন ভালো নয়, আমরা চাই না আমাদের সন্তানরাও সেই জীবন দেখুক।’ সোনালি হলুদ রঙা সালোয়ারে নেপালি গৌরবর্ণা আশা চন্দ ঘুরে বেড়াচ্ছিল আমাদের আশেপাশেই, পর্দা সরিয়ে তাঁবুর ভিতরে ঢুকতে ঢুকতেই বলল এখানে আমি আর আমার স্বামী থাকি।
তাঁবুর ভিতর একটা ডবল বেডের বিছানা, একটা হলদে ডুম জ্বলছে, বিছানার ওপাশে রাখা বেশ কয়েকটা রিঙ। কয়েকটা হাতে তুলে নিমেষে মাথা দিয়ে গলিয়ে পুরো শরীরটাকে রিঙের ভিতর দিয়ে বের করে এনে বলল, ‘আমি একুশ বছর ধরে সার্কাসে খেলা দেখাচ্ছি। এখন এ সব অভ্যাস হয়ে গেছে, প্র্যাকটিস করতেও লাগে না। আমাদের বাড়ির পাশে এক জন বড় দাদা থাকত যে তখন নেপালের মেয়েদের সার্কাসে খেলা দেখানোর জন্য ভারতে নিয়ে আসত। আমায় বলল সার্কাসে চলো খুব ভালো থাকবে। এক বার জিমন্যাস্টিকের খেলা দেখানোর সময়, একটা পাখার মধ্যে আমরা পাঁচ-ছ’জন মেয়ে ঘুরছিলাম, পাখার নব খুলে গিয়ে আমরা সবাই বিভিন্ন দিকে ছিটকে পড়ে যাই। তখন আমার পা ভেঙে গিয়েছিল; সার্কাসের মালিকের সাহায্যে অপারেশন করিয়ে আমার পা জোড়া লাগানো হয়। রিঙের খেলা, বলের খেলা, বন্দুকের খেলা দেখাই। আমার বর এখানে মোটর সাইকেলের খেলা দেখায়।
সূত্র: এই সময়, রবিবায়োয়ারি, ৮ মার্চ ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 10/16/2019