খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্ন পর্যন্ত প্রায় এক সহস্রাব্দ কাল বিষ্ণুপুরের ইতিহাস হিন্দু মল্ল রাজবংশের উত্থান ও পতনের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। বিষ্ণুপুর রাজাদের উৎস রহস্যাবৃত। বহু শতাব্দীকাল তাঁদের বাগদি রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও বিষ্ণুপুরের রাজারা এবং তাঁদের অনুগামীরা দাবি করেন যে তাঁরা উত্তর ভারতের ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভুত। এই অঞ্চলের আর্যীকরণের শেষ পর্যায়ে এই দাবি বিশেষ জোরালো হয়ে ওঠে। বিষ্ণুপুরের রাজারা মল্ল রাজা নামে পরিচিত। সংস্কৃত মল্ল শব্দটির অর্থ মল্লযোদ্ধা। তবে এই শব্দটির সঙ্গে এই অঞ্চলের মাল উপজাতির সম্পর্ক থাকাও সম্ভব। এই উপজাতির সঙ্গে বাগদিদের সম্পর্ক বিদ্যমান।
বিষ্ণুপুর-সংলগ্ন অঞ্চলটিকে অতীতে মল্লভূম বলা হত। মল্লভূম রাজ্যের কেন্দ্রীয় এলাকা ছিল বর্তমান বাঁকুড়া থানা এলাকা (ছাতনা বাদে), ওন্দা, বিষ্ণুপুর, কোতুলপুর ও ইন্দাস। তবে প্রাচীন বিষ্ণুপুর রাজ্যের আয়তন আরও বড়ো ছিল। উত্তরে সাঁওতাল পরগনার দামিন-ই-কোহ থেকে এই রাজ্য দক্ষিণে মেদিনীপুর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। পূর্বে বর্ধমানের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমে ছোটোনাগপুরের একটি অঞ্চলও এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মল্ল রাজারা এই সব অঞ্চলও মল্লভূমের অধিকারে আনেন।
বিষ্ণুপুরের অন্যতম আকর্ষণ জোড়বাংলা(কেষ্ট-রাই) মন্দির। মল্ল রাজা রঘুনাথ সিং ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। ক্লাসিক্যাল চালা শিল্পরীতি অনুযায়ী নির্মিত এই মন্দিরটি। এটি দেখলে মনে হবে দু’টো কুঁড়েঘর একটা ছাদ আর দেওয়াল দিয়ে জোড়া। এর গাত্রে খোদিত টেরাকোটার কাজ অসাধারণ। তৎকালীন রাজাদের কীর্তি রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি বর্ণিত আছে এই টেরাকোটার কাজে ছবির মাধ্যমে। এ ছাড়াও যুদ্ধের ছবি, শিকারের ছবি, তদানীন্তন সমাজজীবনও মূর্ত হয়েছে টেরাকোটার কাজে।
রাজা বীরসিংহ কর্তৃক ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত লালজি মন্দিরটি বাঁকুড়া জেলার চার চালা এক চূড়া মন্দিরগুলির মধ্যে বৃহত্তম। ৫৪ বর্গফুটের ভিত্তিবেদির উপর প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণমুখী মন্দিরটির পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে তিনটি করে তোরণযুক্ত প্রবেশপথ ও সংলগ্ন দালান আছে। চূড়ার নীচের খাড়া অংশের চার দিকে চারটি খিলানযুক্ত অলিন্দ ও সাতটি করে পঙ্খ আছে আর উপরের অংশে কার্নিসের প্রয়োগ, পীঢ়া দেউলদীর্ঘ আকৃতি এবং অলংকরণ মন্দিরটিকে বিশিষ্ট মর্যাদা দান করেছে।
বিষ্ণুপুর টুরিস্ট লজের বিপরীতে বাংলার চালাঘর আর মিশরীয় পিরামিডের সমন্বয়ে ঝামাপাথরে তৈরি রাসমঞ্চটিরও অভিনবত্ব আছে। ৩টি গ্যালারি সমন্বিত ত্রিস্তরের ৬৪ প্রকোষ্ঠের ৩৫ ফুট উঁচু আর দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ৮০ ফুটের এই মঞ্চটি ১৬০৭-এ বীর হাম্বিরের তৈরি। মল্লরাজাদের সময়ে রাসের উৎসব হত এই রাসমঞ্চে। দেবতা রাধা-কৃষ্ণও আসীন হতেন এই মঞ্চে।
সুত্রঃ পোর্টাল কন্টেন্ট টিম
সর্বশেষ সংশোধন করা : 5/15/2020