কাটোয়া-বর্ধমান রেলপথে কাটোয়া থেকে ১৭ আর বর্ধমান থেকে ৩৬ কিলোমিটার দূরে কৈচর স্টেশন। বাস বা রিকশায় কৈচর থেকে ৪ কিমি যেতে ক্ষীরগ্রামের পশ্চিমে দেবী যোগাদ্যা উমা অর্থাৎ সিংহপৃষ্ঠে আসীন কালো কোষ্ঠীপাথরের দশভুজা মহিষমর্দিনী। মন্দির লাগোয়া ক্ষীরদিঘির জলে দেবীর বাস। বছরে মাত্র ৬ দিন দেবী জল থেকে ডাঙায় ওঠেন। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র দু’ দিন ভক্তরা দেবীর দর্শন পান --- বৈশাখ সংক্রান্তির আগের দিন এবং জ্যৈষ্ঠের ৪ তারিখে। বাকি চার্টই দিন, আষাঢ়ী নবমী, বিজয়াদশমী, ১৫ পৌষ এবং মাঘ মাসের মাকরী সপ্তমীতে দেবীকে জল থেকে তুলে পুজো করা হলেও তাঁকে দেখাতে পান না সাধারণ মানুষজন। মন্দিরে রয়েছে প্রবেশমণ্ডপ, তার পরে গর্ভগৃহ। মন্দিরে কোনও বিগ্রহ নাই। কারণ দেবীর বাস তো ক্ষীরদিঘিতে। গর্ভগৃহের দেওয়াল ঘেঁষে বেদী। সেই বেদীতেই দেবীর নিত্যপূজা হয়।
কথিত আছে, ক্ষীরগ্রাম দেবীর ৫১ পীঠের এক পীঠ। কিন্তু প্রাচীন যোগাদ্যা মূর্তিটি কোনও ভাবে হারিয়ে গিয়েছিল। বর্ধমানের মহারাজা কীর্তি চন্দ এই গ্রামে যোগাদ্যার একটি মন্দির নির্মাণ করান। এবং সম্ভবত তাঁরই আদেশে হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটির অনুকরণে একটি দশভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তি তৈরি করেন দাঁইহাটের প্রস্তর শিল্পী নবীনচন্দ্র ভাস্কর। নতুন তৈরি হওয়া মূর্তিটি অবশ্য বছরের অন্যান্য সময়ে ডুবিয়ে রাখা হত ক্ষীরদিঘির জলেই। কেবল ৩১ বৈশাখ তা জল থেকে তুলে এনে সর্বসমক্ষে রাখা হত। এর মধ্যে হঠাৎই ঘটে গেল অলৌকিক এক কাণ্ড। অন্তত গ্রামের মানুষ এই ঘটনাকে অলৌকিক বলেই দাবি করেছেন। কয়েক বছর আগে, ক্ষীরদিঘি সংস্কারের সময় নতুন মূর্তির সঙ্গেই উঠে এল ‘হারিয়ে যাওয়া’ পুরনো যোগাদ্যা মূর্তিটি। মূর্তি ফেরত পাওয়ার আনন্দে আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের সাহায্যে গ্রামের মানুষ গড়ে তুললেন সম্পূর্ণ আলাদা একটি মন্দির। সেই মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হল ফিরে পাওয়া দেবী-মূর্তি। ফলে বহিরাগতরা এখন গ্রামে গেলেই দর্শন পান দেবীর। তবে সংক্রান্তিতে দুই মন্দিরেই চলে দেবীর আরাধনা।
ক্ষীরগ্রামে পুরনো যোগাদ্যা মন্দিরে তোরণদ্বারের স্থাপত্য দর্শকদের বিশেষ নজর টানে। জানা গিয়েছে, এই ক্ষীরগ্রামে একটা সময় বেশ কিছু চতুষ্পাঠী ছিল। মিলেছে বহু প্রাচীন পুঁথি। স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের দাবি, বেশ কয়েক জন পণ্ডিত এই গ্রামে বিদ্যাচর্চা করতেন। গবেষক যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী জানিয়েছেন, এই জনপদে অন্তত ৪০টি যোগাদ্যা বন্দনা পুঁথি মিলেছে। তবে তাঁর মতে, সবথেকে আগে যোগাদ্যা বন্দনা লিখেছিলেন কবি কৃত্তিবাস। কবির মতে, রামায়ণের কালে মহীরাবণ বধের পরে তাঁরই পূজিতা ভদ্রকালী বা যোগাদ্যাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেন রামচন্দ্র।
অদূরে এক টিলার টঙে দেবীর ভৈরব ক্ষীরকণ্ঠ শিবের মন্দির। তাই এই গাঁয়ের নাম ক্ষীরগ্রাম, আদরের ক্ষীরগাঁ। মন্দির আর ক্ষীরদিঘি থেকে খানিকটা দূরে গ্রামের এক প্রান্তে ধামাসদিঘি। পুরাণে আছে, এই দিঘির ঘাটেই যুবতীর বেশে শাঁখা পরেছিলেন উমা। সেই থেকে দেবী বৈশাখের উৎসবে শাঁখা পরেন যোগাদ্যা। আর শাঁখা পরেন ক্ষীরগ্রামের এয়ো বধূরা সারা বছর অপেক্ষায় থেকে। বিশাল মেলা বসে এখানে। ক্ষীরগ্রামও এক সতীপীঠ, দেবীর ডান পায়ের আঙুল পড়েছিল এখানে। অজগাঁ ক্ষীরগ্রামে থাকার জন্য সাধারণ যাত্রীনিবাস আছে।
সূত্র : পোর্টাল কনটেন্ট টিম
সর্বশেষ সংশোধন করা : 8/27/2019