শক্তি চট্টোপাধ্যায় দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বহড়ু গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৩ সালের ২৭ নভেম্বর। তাঁর পিতার নাম বামানাথ চট্টোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম কমলা দেবী। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতাকে হারান এবং দাদুর বাড়িতে বড় হন। তিনি ১৯৪৮ সালে কলকাতার বাগবাজারে আসেন এবং সেখানে একটি স্থানীয় স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। স্কুলের এক জন শিক্ষকের কাছ থেকে তিনি প্রথম মার্কসবাদ সম্পর্কে জানতে পারেন। ১৯৪৯ সালে তিনি প্রগতি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রগতি নামে একটি হাতে লেখা পত্রিকা বের করা শুরু করেন। পরে হাতে লেখা ওই ম্যাগাজিন বহ্নিশিখা নামে মুদ্রিত আকারে বের হয়।
১৯৫১ সালে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন এবং সিটি কলেজে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। একই সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন। পাস করার পর তিনি বাংলা সাহিত্যে অনার্স করার উদ্দেশে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। কিন্তু দারিদ্রের কারণে তাঁকে স্নাতক পাঠ অর্ধসমাপ্ত রেখে প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাড়তে হয়। ১৯৫৬ সালে তাঁকে উল্টোডাঙার একটি বস্তিতে মা ও ভাইকে নিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। সে সময়টায় তাঁর পরিবার পুরোপুরি ভাবে ভাইয়ের সামান্য আয়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল।
১৯৫৬ সালের মার্চে বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় তাঁর যম কবিতাটি ছাপা হয়। পরে তিনি কৃত্তিবাস ও অন্যান্য পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। এরই মধ্যে বুদ্ধদেব বসু তাঁকে নবপ্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য কোর্সে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের কোর্সে ভর্তি হন। কিন্তু এখানেও তিনি পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। ১৯৫৮ সালে শক্তি চট্টোপাধ্যায় কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্কের ইতি টানেন।
জীবিকার জন্য তাঁকে সাক্সবি ফার্মা লিমিটেডে স্টোর সহকারীর চাকরি করতে হয়েছে। কিছু কাল তিনি ভবানীপুর টিউটোরিয়াল হোমের হ্যারিসন রোড শাখায় শিক্ষকতাও করেছেন। কিছু দিন ব্যবসা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাতে সফল হতে না পেরে একটি মোটর কোম্পানিতে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও কাজেই তিনি ঠিক মন বসাতে পারেননি।
বাংলা সাহিত্যে স্থিতাবস্থা ভাঙার আওয়াজ তুলে, ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে, শিল্প ও সাহিত্যের যে একমাত্র আন্দোলন হয়েছে, তার নাম হাংরি আন্দোলন। আর্তি বা কাতরতা শব্দগুলো মতাদশর্টিকে সঠিক তুলে ধরতে পারবে না বলে, আন্দোলনকারীরা শেষাবধি হাংরি শব্দটি গ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায়। শেষোক্ত তিন জনের সঙ্গে সাহিত্যিক মতান্তরের জন্য ১৯৬৩ সালে শক্তি চট্টোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করে কৃত্তিবাস গোষ্ঠীতে যোগ দেন। পরবর্তী কালে কৃত্তিবাসের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম সাহিত্যিক মহলে একত্রে উচ্চারিত হত, যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাংরি আন্দোলনের ঘোর বিরোধী ছিলেন।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা প্রথম উপন্যাসের নাম ছিল কুয়োতলা। কিন্তু কলেজ জীবনের বন্ধু সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে আড়াই বছর থাকার সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় এক জন সফল গীতিকবিতে পরিণত হন। নিজের কবিতাকে তিনি বলতেন পদ্য। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো (১৯৬৭), সোনার মাছি খুন করেছি (১৯৬৮); অন্ধকার নক্ষত্রবীথি তুমি অন্ধকার (১৯৬৮); হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান (১৯৬৯); চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৯৭০); পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি (১৯৭১); প্রভু নষ্ট হয়ে যাই (১৯৭২); সুখে আছি (১৯৭৪); ঈশ্বর থাকেন জলে (১৯৭৫); অস্ত্রের গৌরবহীন একা (১৯৭৫); জ্বলন্ত রুমাল (১৯৭৫); ছিন্নবিচ্ছিন্ন (১৯৭৫); সুন্দর এখানে একা নয় (১৯৭৬); কবিতায় তুলো ওড়ে (১৯৭৬), ভাত নেই পাথর রয়েছে (১৯৭৯); আঙ্গুরী তোর হিরণ্য জল (১৯৮০); প্রচ্ছন্ন স্বদেশ (১৯৮১); যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো (১৯৮৩); কক্সবাজারে সন্ধ্যা (১৯৮৫); সন্ধ্যার সে শান্ত উপহার (১৯৮৬); এই তো মর্মর মুর্তি (১৯৮৭); বিষের মধ্যে সমস্ত শোক (১৯৮৮); আমাকে জাগাও (১৯৮৯); ছবি আঁকে ছিঁড়ে ফ্যালে (১৯৯১); জঙ্গলে বিষাদ আছে (১৯৯৪); বড়োর ছড়া (১৯৯৪); সেরা ছড়া (১৯৯৪); টরে টক্কা (১৯৯৬); কিছু মায়া রয়ে গেল (১৯৯৭); সকলে প্রত্যেকে একা (১৯৯৯); পদ্যসমগ্র ১ম খণ্ড থেকে ৭ম খণ্ড ইত্যাদি।
কবিপ্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় আনন্দ পুরস্কার ও সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৯৫ সালের ২৩ মার্চ তাঁর মৃত্যু হয়।
তথ্যসূত্র: breakingnews.com.bd
সর্বশেষ সংশোধন করা : 7/13/2020