অধুনা পুরুলিয়া তখন মানভূম। ১৯৩৩-এর ৩০ সেপ্টেম্বর সেখানকার রোপো গ্রামে মামাবাড়িতে জন্মান অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। বেশ কয়েক বছর পরে কলকাতায় পা রেখে তাঁর নাম পরিবর্তিত হয় অজিতেশে।
ভুবনমোহন ও লক্ষ্মীরানির বড় ছেলে অজিত। বাবা কোলিয়ারিতে কাজ করেন। আসানসোল শিল্পাঞ্চলের রামনগরে। একটু বড় হতেই অজিত দেখলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেটা ১৯৪২, তখন তাঁর বয়স বছর নয়েক। জাপানি বোমার ভয়ে ভুবনমোহন তাঁকে পুরুলিয়ার ঝালদায় এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে অজিত তিনটি বিষয়ের প্রেমে পড়ে গেলেন — ফুটবল, রাজনীতি এবং থিয়েটার। প্রথমটির ঘোর অল্প দিনের মধ্যেই কেটে যায়। দ্বিতীয়টিতে প্রভাবিত করে গাঁধীজির লেখা। কিন্তু পরের দিকে কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকেছিলেন। বেশ কিছু কাল সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নিয়েছিলেন। তবে থিয়েটারের মগ্নতা আমৃত্যু কাটাতে পারেননি অজিত। ঝালদা থেকে বছরখানেকের মধ্যেই ফিরে এলেন রামনগর। কুলটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর ভুবনমোহন বদলি হয়ে গেলেন ঝরিয়ার কাছে চাসনালায়। সেখানেই নাট্যগুরুর দেখা পেলেন অজিত। নাম প্রবোধবিকাশ চৌধুরী। তাঁর সঙ্গেই পাথরডি রেলওয়ে ইনস্টিটিউটে ‘টিপু সুলতান’-এ জীবনের প্রথম অভিনয় করেন অজিত।
ইংরেজির স্নাতক অজিত শিক্ষক হিসেবে কাজে যোগ দিলেন। পাশাপাশি তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। বাগুইআটির হিন্দু বিদ্যাপীঠের ইংরেজির শিক্ষক, পার্টি কর্মী, তথা গণনাট্য সঙ্ঘ পাতিপুকুর শাখার শিল্পী অজিতকে তখন সবাই এক ডাকে চেনে। দমদম আঞ্চলিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর দায়িত্ব পড়ে গণনাট্য সঙ্ঘের চারটি শাখাকে মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনা তৈরি করার। মঞ্চস্থ হল ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’। তার পর ধারাবাহিক ভাবে সঙ্ঘের কাজ করেছেন তিনি, মূলত থিয়েটারকে আঁকড়ে। প্রথম দিকে তারই শাখা হিসেবে কাজ করত ‘নান্দীকার’। কিন্তু সঙ্ঘের সঙ্গে মানসিক দূরত্ব আর বিচ্ছিন্নতা বাড়তে থাকে। তাই গণনাট্য সঙ্ঘ থেকে সরে এসে ১৯৬০-এর ২৯ জুন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে, দীপেন্দ্র সেনগুপ্ত এবং অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহায়তায় স্বতন্ত্র সত্তায় আত্মপ্রকাশ করল ‘নান্দীকার’। এর পর প্রায় ১৭ বছর এই সংগঠনের সঙ্গে থিয়েটারকে নিয়ে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছিলেন অজিতেশ।
এই দলের প্রথম নাটক ইবসেনের ‘ঘোস্টস’। বাংলায় ‘বিদেহী’। একটি মাত্র অভিনয়ের পর বন্ধ হয়ে যায় এই নাটকের শো। ’৬০-’৬১-তে পর পর কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ করে নান্দীকার। মৌলিক এবং বিদেশি নাটক নির্ভর ‘দাও ফিরে সে অরণ্য’, ‘সেতুবন্ধন’, ‘চার অধ্যায়’, ‘প্রস্তাব’ করার পর ১৯৬১ সালের ১২ নভেম্বর অভিনীত হল ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’। এই নাটক বাংলা থিয়েটারে নান্দীকার-এর নাম দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। এর পর অজিতেশের নির্দেশনায় একের পর এক মঞ্চসফল প্রযোজনা করেছে নান্দীকার। ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’, ‘যখন একা’, ‘নানা রঙের দিন’, ‘তিন পয়সার পালা’, ‘শের আফগান’, ‘ভাল মানুষ’— তালিকায় নাম বাড়তেই থাকে। নির্দেশনার পাশাপাশি নাটকের গান তৈরি করা, সে গানের সুর দেওয়া, বিদেশি নাটকের আত্তীকরণ, মৌলিক নাটক লেখা— সবই চলতে থাকে অজিতেশের।
১৯৭৭-এ ‘সাংগঠনিক কারণ’-এ নিজেরই তৈরি করা দল নান্দীকার ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন অজিতেশ। ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর তিনি গঠন করলেন নতুন সংস্থা, ‘নান্দীমুখ’। প্রথম দিকে নান্দীকারে করা তাঁর পুরনো নাটকগুলিই মঞ্চস্থ করত নান্দীমুখ। ‘নানা রঙের দিন’, ‘শের আফগান’, ‘তামাকু সেবনের অপকারিতা’, ‘প্রস্তাব’ ইত্যাদি নাটক দিয়েই পথ চলতে থাকে অজিতেশের নতুন দল।
বিদেশে বসে লেখা, সে দেশের পটভূমিতে লেখা বিভিন্ন নাটক অজিতেশের ছোঁয়ায় হয়ে উঠত ঘরের নাটক। এই বাংলার নাটক। ভিন্ন দেশ-কাল-পরিবেশ-পরিস্থিতি-পাত্রপাত্রী যেন হয়ে উঠত একান্ত ভাবেই এ দেশের। বা বলা ভালো, এই বঙ্গের। ব্রেখট, ইবসেন, চেখভ, পিরানদেল্লো, ওয়েস্কার, পিন্টার— বিশ্ব নাট্যমানচিত্রের এই সব স্থপতির সঙ্গে বাঙালির পরিচয় অজিতেশের হাত ধরে। এঁদের নাটকের অনুবাদ নয়, বঙ্গীয়করণ করে তিনি উপস্থাপন করতেন মঞ্চে।
অভিনয় শিল্পের সব ক’টি মাধ্যমেই কাজ করেছেন অজিতেশ। মঞ্চ নাটকে তো তিনি অবিসংবাদিত অভিনেতা ছিলেনই, বাংলা চলচ্চিত্র এবং যাত্রাশিল্পও সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁর অভিনয়ে। বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে মোট ৬৩টি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন।
১৯৮৩-র ১৩ অক্টোবর মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বাংলা অভিনয় জগতের প্রবাদপ্রতিম এই শিল্পী।
সূত্র: anandabazar.com
সর্বশেষ সংশোধন করা : 5/25/2020