আমাদের দেশে মনুর ধর্মশাস্ত্রের আইনে (আনুমানিক ১২৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৮৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ধর্ম, বিশেষ করে ব্রাহ্মণত্বের প্রভাব বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। হিন্দুদের মধ্যে জাতিভেদকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা ও বিভিন্ন ধরনের আইনের সঙ্গে সেই জাতিভেদকে জড়িত করা হয়েছে এই আইন-পুস্তকে। তবে মনু শাস্তির বিধান দিয়েছেন অল্প ক্ষেত্রেই। অঙ্গচ্ছেদনের উল্লেখ শাস্তি হিসেবে থাকলেও, সাধারণ ভাবে শাস্তিগুলি অত ভয়াবহ নয়। কোটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও (আনুমানিক ২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বেশ কিছু আইনের উল্লেখ আছে। সেখানেও ধর্মের প্রচ্ছন্ন প্রভাব লক্ষ করা যায়। কৌটিল্যের কিছুকাল আগে সম্রাট অশোক (আনুমানিক ২৬৫-২৩৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, মতান্তরে ২৭৪-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) বিভিন্ন প্রস্তর-স্তম্ভে আইন বিষয়ক বিভিন্ন রাজাজ্ঞা বা নির্দেশ জারি করেছিলেন। এই রাজাজ্ঞার বেশ কয়েকটিতে অশোকের উদার ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর সপ্তম প্রস্তর-স্তম্ভ রাজাজ্ঞার (সেভেন পিলার এডিক্টস) এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন:
‘আবেদন (প্রার্থনা) শোনার ও তার বিচারের ভার রজ্জুকদের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে, যাতে তারা তাদের কর্তব্য নির্ভয়ে অবিচলিত চিত্তে বিশ্বস্ত ভাবে পালন করতে পারে। আমার ইচ্ছা যে আইন এবং সাজার মধ্যে যেন সব সময়ে সমতা থাকে (ইউনিফরমিটি অফ ল অ্যান্ড ইউনিফরমিটি ইন সেনটেন্সিং)। এমনকী আমি এত দূর পর্যন্ত গিয়েছি যে, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামী যারা এখন কারাগারে আছে, তাদের ওপর দণ্ডাদেশ পালন করা তিন দিনের জন্য স্থগিত রেখেছি। এই সময়ের মধ্যে তাদের আত্মীয়রা আবেদন জানাতে পারে - মৃত্যুদণ্ড মকুবের জন্য। যদি কেউ আবেদন না করে, তা হলে আসামীরা দান-ধ্যান বা উপবাস করে পর-জীবনের জন্য পূণ্য অর্জন করতে পারে। বলা বাহুল্য আমার ইচ্ছা এই যে, যদিও আসামিদের স্বল্প সময়, কিন্তু তার মধ্যেও তারা পর-জীবনের জন্য প্রস্তুত হতে পারে এবং সাধারণের ধর্মাচরণ, আত্ম-সংযম ও বদান্যতা বৃদ্ধি পায়।’ ধর্মের প্রভাব সে যুগের বিচারব্যবস্থার ওপর থাকলেও বিচারের ভার সাধারণত রাজা বা গোষ্ঠীপ্রধানেরই হাতে ছিল। বড় বড় রাজাদের পক্ষে একা এই কাজ করা সম্ভবপর ছিল না। তাই নিজেদের আত্মীয় বা অমাত্যদের ওপর ভার দিতেন বিচারকের কাজ করার জন্য। তবে অনেক সময়েই রাজারা স্বাধীন ভাবে তাঁদের ন্যায়পালন বা বিচার করার ক্ষমতা হারিয়েছেন, যখন তাঁদের রাজ্যে ধর্মের জোয়ার এসেছে। সে ক্ষেত্রে দেখা গেছে ধর্মপ্রধানেরা (যাজকগোষ্ঠী, মোল্লাসমাজ প্রভৃতি) বিচারকের আসনে বসেছেন কিংবা না বসলেও বিচারকদের গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছেন। চিন দেশ ও বহু মুসলিম দেশে বিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত (কোথাও কোথাও এখনও) এই অবস্থা বিদ্যমান ছিল।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 11/14/2019