কেমব্রিজের পরিচিত পানশালা ‘ঈগ্ল’ সে দিন পরিপূর্ণ ছিল সপ্তাহান্তিক আমোদপ্রিয় মানুষের ভিড়ে। তাঁদের ক’জন কর্ণপাত করেছিলেন সেই খবরে, তা জানা নেই। হয়তো তখন সে দিকে মনোযোগের অবকাশ ছিল না কারও। কিন্তু, তাতে কী আসে যায়? ‘ইউরেকা’ উচ্চারণের উন্মাদনা তো মনে রাখে না স্থান-কাল। তার প্রভাবে অর্ধস্নাত বসনহীন বিজ্ঞানীও ছুটতে পারেন রাজপথে। ক্যাভেনডিশ ল্যাবরেটরির গবেষক ফ্রান্সিস ক্রিক তাই সে দিন গোপন রাখতে পারেননি তাঁর আনন্দ। শনিবারের দুপুরে সেখানে ঢুকে সগর্বে ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘আমরা আবিষ্কার করে ফেলেছি প্রাণের রহস্য।’’ ‘আমরা’ আসলে দু’ জন। বিজ্ঞানী ম্যাক্স ফার্দিনান্দ পেরুৎজ-এর দুই সহকারী। ক্রিক এবং তাঁর বন্ধু জেমস ডিউই ওয়াটসন।
পঞ্চাশ বছর আগে, ১৯৫৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, গবেষণায় তাঁদের যুগলবন্দি জীববিদ্যাকে উপহার দিয়েছিল এক অত্যাশ্চর্য জ্ঞান। যে কোনও প্রাণীর, তা সে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া কিংবা প্রকাণ্ড তিমিমাছ যা-ই হোক না কেন— জন্ম, জীবনধারণ এবং মৃত্যুর মূলে দায়ী রাসায়নিক পদার্থটি দেখতে কেমন, তা বলে দিয়েছিলেন তাঁরা। কী সেই মহার্ঘ পদার্থ? ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড। হ্যাঁ, সংক্ষেপে ডি এন এ। প্রাণীর দেহকোষে উপস্থিত পেল্লায় এক অণু। এবং মস্ত বড় খেলোয়াড়। পুরুষ ও নারীর শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনে সন্তান আবির্ভাবে, আর, তার পর সেই সন্তানের জীবনযৌবনে, জরায় ও ব্যাধিতে মুখ্য ভূমিকা ওই অণুর। তার গঠন আবিষ্কার, অতএব, প্রাণের রহস্যভেদ। ক্রিক এবং ওয়াটসন-এর সাফল্য বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় এক উজ্জ্বল মাইলস্টোন। মানুষকে ডি এন এ-র আকৃতি বলে দিয়ে, আর, তার পর সেই মহামূল্যবান অণুর ক্রিয়া ব্যাখ্যা করে তাঁরা প্রমাণ করে দেন প্রাণের চালিকাশক্তি অতীন্দ্রিয় কিছু নয়। তা স্রেফ অণু-পরমাণুর রসায়ন। এই জ্ঞানার্জন, বিজ্ঞানী স্যর পিটার মেডাওয়ার-এর মতে, ‘‘দ্য গ্রেটেস্ট অ্যাচিভমেন্ট অব সায়েন্স ইন দ্য টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি।’’
তার পর জন্মসূত্রে ভারতীয় বিজ্ঞানী হরগোবিন্দ খুরানা ব্যাখ্যা করেছেন জিন থেকে প্রোটিন সৃষ্টির সমাচার। জানা গেছে প্রতিটি মানুষের ডিএনএ-র মধ্যে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন প্রোটিন তৈরির নকশা বা ‘জেনেটিক কোড’। ডিএনএ থেকে আরএনএ-এর মাধ্যমে প্রোটিন তৈরির জটিল পদ্ধতি আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেল এই প্রক্রিয়ায় গোলযোগের ফলে সৃষ্ট হতে পারে নানা জন্মগত জিনঘটিত অসুখ (যেমন, থ্যালাসেমিয়া)। সাধারণ ওষুধে অসম্ভব বলে, এই সব অসুখের চিকিৎসার জন্য ‘জিন থেরাপি’র চর্চা শুরু হল।
১৯৯৭ সালে ‘ভগবানের কর্মশালায়’ হাত দিল মানুষ। নারী পুরুষের মিলন ছাড়া ক্লোনিং-এর দ্বারা তৈরি হয়েছে মেষশাবক ডলি। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বাস্তব হয়ে উঠেছে। বিপুল পরিমাণে তৈরি করা সম্ভব হয়েছে নানা ওষুধ, টিকা এবং অন্যান্য প্রতিষেধক। ‘হিউম্যান জিনোম প্রোজেক্ট’ মানুষের কোষের ৪৬টি ক্রোমোজমের প্রতিটি জিনকে চিহ্নিত ও বিশ্লেষণ করার অসম সাহসী কাজে ব্রতী। তবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর কুফলও কি নেই? কৃষি ক্ষেত্রে নানা ধরনের ফসল ও দানা শস্যে (যেমন, বিটি বেগুন, বিটি তুলো, সোনালি ধান প্রভৃতি) অন্য জীব বা প্রাণী থেকে নানা ধরনের জিন ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে জৈব প্রযুক্তির (Biotechnology) নামে। জিন পরিবর্তিত এই ফসল নিয়ে বিশ্বজোড়া বির্তক চলছে। আশঙ্কা, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের পক্ষে তা বিপজ্জনক হবে। অনাকাঙ্ক্ষিত পরাগ সংযোগের ফলে আক্রান্ত হতে পারে চিরায়ত প্রাকৃতিক বীজ। ধ্বংস হয়ে যেতে পারে স্বাভাবিক জীববৈচিত্র্য। তাই ‘শিব গড়তে বাঁদর’ গড়ার এই কুফল সম্পর্কে অবশ্যই আমাদের সচেতন থাকতে হবে।
সূত্র : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংসদ ও দফতর, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/29/2020