“এক দিন বৃষ্টিতে বিকেলে
থাকবে না সাথে কোন ছাতা,
শুধু দেখা হয়ে যাবে মাঝ রাস্তায়
ভিজে যাবে চটি-জামা-মাথা,
থাকবে না রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া
দোকান-পাট সব বন্ধ
শুধু তোমার আমার হৃদয়ে
ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধ ।”
— অঞ্জন দত্ত
প্রথমেই আমেজটা তৈরি করে নেওয়া যাক । ওপরের গানের লাইনগুলো মনে পড়ছে ? তোমাদের কম্পিউটারে এই গানটা নেপথ্যে চলতে থাকুক । ভাবছ এত গৌরচন্দ্রিকা কীসের জন্য ? শুধু তোমাদের একটু সোঁদা গন্ধটা মনে করিয়ে দিতে চাইছি, পাছে ভুলে গিয়ে থাকো । গরমকালে দুপুরবেলা জানালার পাশে বসে আছ হয়ত । আকাশ কালো করে এসেছে, বৃষ্টি নামবে এখুনি । বলতে বলতেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল । এমন সময় হঠাৎ নাকে এল সেই অদ্ভুত মায়াজড়ানো গন্ধ … সোঁদা গন্ধ ।
কত কবি, কত গীতিকার এই সোঁদা গন্ধ নিয়ে কবিতা, গান লিখেছেন । গরমকালে কত সময় এই গন্ধের জন্য অপেক্ষা করে থেকেছি । তোমরা নিশ্চয় একমত হবে এ ব্যাপারে । কিন্তু এই গন্ধ এল কোথা থেকে ? মাটির কি নিজের গন্ধ হয় নাকি ? অনেকে বলেন রোদ্দুরে তেতেপুড়ে থাকা মাটি জল পেয়ে এমন বাষ্প তৈরি করে । হবে হয়ত । কিন্তু তার এমন গন্ধ কেন ? ভাবার বিষয় বটে । এটাও নিশ্চয় শুনেছ যে উট মরুভূমিতে ঠিক মরূদ্যান খুঁজে বার করে । কিন্তু প্রশ্ন হল করে কী ভাবে ?
১৯৬৫ সালে বিজ্ঞানীরা প্রথম একটি রাসায়নিক যৌগ পদার্থের সন্ধান পান যা কটিনোমায়সিটিস গোত্রের ব্যাকটেরিয়া তৈরি করে থাকে । সেই যৌগটির রাসায়নিক গঠন নীচে দেওয়া হল । বাঁ দিকের ছবিটাকেই ত্রিমাত্রিক ভাবে আঁকলে ডান দিকের ছবির মতো দেখায় ।
এর নাম জিওস্মিন । মজার ব্যাপার হল আমরা এই জিনিসটি বাতাসে খুব অল্প পরিমাণে থাকলেও গন্ধ পাই । সঠিক ভাবে বলতে গেলে বাতাসে একশো কোটি ভাগের এক ভাগ থাকলেও এর গন্ধ পাওয়া যায় । আর উট অথবা অন্য বহু প্রাণী তো আরও বেশি করে এর গন্ধ পায় । কিন্তু তোমরা হয়ত জিগ্যেস করবে তা হলে বৃষ্টির সময় ছাড়া এর গন্ধ পাই না কেন ? আসলে যে ব্যাকটেরিয়া জিওস্মিন তৈরি করে তারা মাটিতে বাস করে, মাটির মধ্যেই তাদের জীবনাবসান ঘটে, আর বৃষ্টির জল পড়লে তাদের মৃত কোষগুলো থেকে জিওস্মিন বেরিয়ে আসে । তখন আমরা গন্ধটা পাই । এটাও লক্ষ কোরো যে শুকনো আবহাওয়ার মধ্যে বৃষ্টি পড়লে এর গন্ধ আরও বেশি করে পাওয়া যায় । তার কারণ হল শুকনো আবহাওয়াতে অন্য জৈবপদার্থের পরিমাণ কম থাকে তাই অন্য গন্ধ বেশি পাওয়া যায় না ।
জিওস্মিন আবিষ্কারের পর বেশ কয়েক দশক কেটে গেছে । বিজ্ঞানীরা এর মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে উৎসেচকটিকেও খুঁজে বার করেছেন যা এই অণুটি তৈরি করে । গবেষণাগারে তাঁরা সেই উৎসেচকের রাসায়নিক কিছু পরিবর্তন করে জিওস্মিন তৈরি করার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছেন । এর ফলে কী হতে পারে ভাবো । সোঁদা গন্ধ আর পাবে না ঠিকই কিন্তু অনেক সময় জিওস্মিন পানীয় জলে মিশে গিয়ে যে জলদূষণ হয় তা থেকে বাঁচা যাবে । কিন্তু সোঁদা গন্ধ না পেলে তোমাদের মন খারাপ করবে না ?
ভারতের নানা জায়গায় বেশ কিছু দেশীয় সুগন্ধি দ্রব্য তৈরির শিল্প গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতা এবং তার পরবর্তী কিছু বছরের মধ্যে । তারা গরমকালে মাটি শুকিয়ে তারপর বর্ষার আগে বাষ্প-পাতন (স্টিম ডিস্টিলেশন) করে সেই বাষ্প চন্দনের তেলে মিশিয়ে নিত আর তার পর সেই তেল বিক্রি করত বাজারে । উত্তর প্রদেশে এর জনপ্রিয় নাম ছিল “মিট্টি কি আতর” । এখনও সেই তেল পাওয়া যায় কিনা অবশ্য বলতে পারব না ।
(ছবি: পথের পাঁচালী)
সূত্র: bigyan.org.in
সর্বশেষ সংশোধন করা : 12/11/2019