১৯৩৮ সালের ১৩ জুলাই প্রাণের আশঙ্কায় লিজে মাইটনার ৬৬ বছর বয়সে জার্মানির বার্লিন থেকে হল্যান্ডে পালান। সেখানে ডির্ক রোস্টারের সংস্থায় তিনি যখন যুক্ত হন, তখন তাঁর হাতে ছিল কেবল একটি সুটকেস।
পারমাণবিক বিদারণ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে লিজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, যার থেকেই পরবর্তীতে পরমাণু বোমা এবং পারমাণবিক চুল্লি তৈরি হয়েছে। জীবনের দীর্ঘ সময় তাঁকে প্রাণ বাঁচাতে ছুটে বেড়াতে হয়েছে, চাকরি ও পদমর্যাদা হারিয়েছেন, বন্ধুদের হারিয়েছেন, প্রিয় গবেষণাগারটি ত্যাগ করতে হয়েছে, শুধু বয়ে বেড়িয়েছেন পদার্থবিদ্যার প্রতি তীব্র আবেগ আর ভালবাসা। এটা দুঃখের যে আজ তাঁর নাম খুব কম মানুষই মনে রেখেছে। কিন্তু সে সময় তাঁকে দুনিয়ার অন্যতম সেরা গবেষণাধর্মী পদার্থবিদ বলে মনে করা হত। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমাদের নিজেদের মেরি কুরি।
অটো হান এবং ফ্রিৎজ স্ট্রাসমানের সঙ্গে যৌথ ভাবে বিদারণ আবিষ্কারের কাজে নেতৃত্ব দিলেও, সেই কাজের জন্য নোবেল পেয়েছিলেন হান একাই। যে সময়টায় তিনি বেঁচেছিলেন, এটি সেই সময়টারই আরও একটি দুঃখজনক ঘটনা।
লিজে মাইটনার অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় ১৮৭২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। প্রথম যে সব মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, মাইটনার ছিলেন তাঁদের অন্যতম। লুডভিগ বোলৎজমানের মতো খ্যাতনামা ব্যক্তির কাছে অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যা শিখেছিলেন তিনি। এর পর তিনি বার্লিনে চলে যান, সেখানে তিনি বন্ধু ও শিক্ষক হিসেবে পান মাক্স প্লাঙ্ককে। সেখানে তিনি যৌথ ভাবে কাজ শুরু করেন রসায়নবিদ অটো হানের সঙ্গে। ১৯২০ সালে হান-মাইটনার জুটি তেজস্ক্রিয়তা সম্পর্কে বেশ কিছু পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করেন।
১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে আইরিন কুরি ও ফ্রেডেরিখ জোলিওট কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন। হিলিয়ামের নিউক্লিয়াসের সঙ্গে অ্যালুমিনিয়ামের মতো হালকা মৌলিক পদার্থের সংঘর্ষ ঘটিয়ে আবিস্কৃত হল নতুন তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ। লিজে মাইটনার এতে অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। তিনি যে শুধু নিজের গবেষণায় এর সত্যতা প্রমাণ করেন তাই নয়, প্রক্রিয়াটিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। ইতিমধ্যে এনরিকো ফের্মি রোমে গবেষণা শুরু করেন। তাঁর ধারণা ছিল, নিউট্রন ব্যবহার করে কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা তৈরি কর যায়। খুব দ্রুত তিনি আবিষ্কার করেন, নিউট্রনকে আঘাত করার মাধ্যমে ইউরেনিয়ামের নতুন কার্যকারিতা তৈরি হয়, যার রসায়ন ইউরেনিয়াম বা অন্য যে কোনও মৌলের থেকে আলাদা। এর পর থেকেই ‘ইউরেনিয়াম পরবর্তী’ মৌল নিয়ে চর্চা শুরু হয়।
লিজে শুধু নিজেই এই চর্চায় যোগ দিলেন না, অটো হানকেও উৎসাহিত করলেন। তিনি নিউট্রনের শক্তি নিয়ে বিস্তৃত চর্চা শুরু করলেন এবং তিনি ছিলেন অন্যতম প্রথম ব্যক্তিত্ব যাঁরা দেখেছিলেন নিউক্লীয় বিক্রিয়ায় ধীর গতির কণাগুলিকেই দ্রুত গতির কণার তুলনায় আগে ধরা যায়। ১৯৩৫ সালের বসন্তে হান, মাইটনার এবং তরুণ পদার্থ রসায়নবিদ স্ট্রাসমান নিউক্লীয় প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তৃত চর্চা করেন । মাইটনার পদার্থবিদ্যার দিকটি দেখতেন, অন্যরা রসায়ন। তাঁরা সকলেই গবেষণাটিতে ব্যাপক পরিশ্রম করেছিলেন।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 11/14/2019