পশু-পাখি, পোকা-মাকড় এরা খাবার পায় কোথা থেকে ? আমাদের মতো এদের তো আর পাড়ার মুদির দোকান নেই, তাই এদেরকে খাবার খুঁজতে হয় । খাবার খোঁজাকে ইংরেজিতে বলে Foraging । যেমন ধরো, তোমরা দূর্গাপুজোর সময় এগরোলের দোকান খুঁজে বেড়াও, খুঁজে বেড়াও কোথায় সব থেকে ভালো ফুচকা পাওয়া যায়, বা কুকুর-বিড়ালরা বাড়ি বাড়ি কাঁটাটা-কুটোটা খুঁজে বেড়ায়,একেই বিজ্ঞানীরা বলেন Foraging। মানুষ, কুকুর, বিড়ালরা এদের একলা-একলাই জীবন কাটে, বাঁচার জন্য সাধারণত এদেরকে কারোর ওপর নির্ভর করতে হয় না। তাই এই সমস্ত প্রাণীকে বিজ্ঞানীরা বলেন Solitary বা একান্তবাসী জীব। আবার, পিঁপড়ে-মৌমাছিরা একা একা কখনও বাঁচতে পারে না , একটা মৌমাছির চাকের বাসিন্দারা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। তাই এদেরকে বলা হয় Social বা সামাজিক জীব। তোমরা হয়ত জানো যে একটা মৌমাছির চাকে মূলত তিন ধরনের মৌমাছি থাকে – রানি, পুরষ আর কর্মী মৌমাছি। রানি মৌমাছি আর পুরুষ মৌমাছির একমাত্র কাজ হল বংশ বিস্তার করা। খাবার জোগাড়, ডিম-বাচ্চাদের লালন-পালন, মৌচাককে শত্রুদের থেকে রক্ষা করা, রানি-পুরুষ মৌমাছিদের পরিষ্কার রাখা, এই সব কিছুরই দায়িত্ব হল কর্মী মৌমাছিদের। স্বাভাবিক ভাবেই একটা কর্মী মৌমাছির পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব নয়, তাই এক এক দল কর্মী-মৌমাছি তাদের কাজ ভাগ করে নেয়। আমি আজ যাদের কথা বলব তাদের কাজ হল খাবার খোঁজা। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এদের বলে forager বা জোগাড়ে মৌমাছি।
খাবার খোঁজার জন্য প্রথমে অল্প কিছু মৌমাছি চারিদিকে উড়ে যায়। এ বার ধরা যাক, মৌমাছি এমন একটা পেল যাতে অনেক পরাগরেণু আছে। কিন্তু শুধু নিজে জানলেই তো হবে না, অন্যদেরও জানাতে হবে। তাই, এই মৌমাছিটা চাকে ফিরে যায়, আর গিয়ে একটা অদ্ভুত নাচ নাচে, যাকে বলে Waggle Dance। এই নাচের থেকে অন্য মৌমাছিরা জেনে যায় একদম ঠিক কোথায় সেই ফুলটা খুঁজে পাওয়া যাবে। কার্ল ফন ফ্রিশ নামে এক অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী গত শতকের চল্লিশের দশকে এটা আবিষ্কার করেন এবং এই ১৯৭৩ সালে নোবেল পুরস্কার পান। কিন্তু ফুলের অবস্থান বোঝানো তো সহজ ব্যাপার নয় মোটেই। চাক থেকে ফুলের অবস্থান বোঝানোর জন্য শুধু দূরত্ব বোঝালেই তো হবে না, চাকের কোন দিকে ফুলটা অবস্থিত, সেটাও তো জানা দরকার অর্থাৎ ফুলের অবস্থান একটা ভেক্টর রাশি। কিন্তু একটা নাচের মাধ্যমে মৌমাছি এই অবস্থান বোঝায় কী করে ? ব্যাপারটা খুব আগ্রহজনক।
(মৌমাছির নাচ : মৌমাছিটি বাংলার ৪-এর আকারের একটি পথে বারবার ঘুরতে থাকে। মাঝের অংশটাতে মৌমাছিটি শরীরের পিছনের অংশটা পর্যায়ক্রমে নাড়াতে থাকে। ওই মাঝের অংশটি যে দিকে নির্দেশ করে সেই দিকেই ফুলটা থাকে । ছবি : Wikimedia)
তোমরা জানো আলো হল এক ধরনের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। তরঙ্গের একটা চুম্বকীয় ভাগ থাকে আর একটা বৈদ্যুতিক ভাগ থাকে এবং দু’টি ভেক্টর রাশি। সুতরাং তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ একটি ভেক্টর তরঙ্গ , যাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলে অনুপ্রস্থ তরঙ্গ বা transverse wave। যে হেতু এটা একটা ভেক্টর তরঙ্গ, তাই এর একটি দিকও থাকে, একে বলা হয় তরঙ্গটির Polarization ( সাধারণত বৈদ্যুতিক ভাগের দিককে polarization হিসেবে ধরা হয়)। সূর্যের আলো যখন বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৃথিবীতে প্রবেশ করে তখন বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগের আয়নগুলির প্রভাবে polarized হয়ে যায় এবং এই polarization-এর দিক সূর্যের দিকে হয়! মানুষের চোখ সেটা ধরতে পারে না কিন্তু মৌমাছির পুঞ্জক্ষিতে তা ধরা পড়ে এবং আমরা যে ভাবে ধ্রুবতারাকে দেখে দিক ঠিক করতে পারি সেই রকম মৌমাছিরাও সূর্যকে কম্পাস হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
এর পরের ব্যাপারটা কতকটা সহজ। ফুল খুঁজে পাওয়ার পর মৌমাছিটা চাকে ফিরে উপরের ছবির মতো নাচ নাচে। পৃথিবীর অভিকর্ষ যে দিকে হয় ঠিক তার উল্টো দিককে ওরা সূর্যের দিক হিসেবে ধরে; এইটা হল ওদের দিকনির্ণয়ের মাপকাঠি। এর পর, মৌমাছিটি বাংলার ৪-এর মতো একটা পথে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে আর মাঝের অংশটায় শরীরের পিছনের দিকটা নাড়াতে থাকে ( উপরের ছবির মতো , একেই বলে waggle dance )। আশে-পাশে যে সমস্ত মৌমাছি থাকে ওরা ওই মাঝের অংশটা লক্ষ করে। এই মাঝের অংশটা যে দিকে নির্দেশ করে ওটাই ফুলের দিক! কিন্তু শুধু দিক বললেই তো হবে না, দূরত্বও তো জানাতে হবে। এটাও ওই নাচের মাধ্যমেই বুঝতে পারে! মৌমাছিটি মাঝের অংশের নাচটা যত বেশিক্ষণ ধরে নাচে, ফুলটাও তত বেশি দূরে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, এক সেকেন্ড ধরে নাচলে ফুলটা মোটামুটি এক কিলোমিটার দূরে থাকে। মজার ব্যাপার হল মৌমাছিদের দূরত্বের কোনও ধারণাই নেই, আছে শুধু সময়ের জ্ঞান। বেশির ভাগ প্রাণীর ক্ষেত্রেই সেটা সত্যি, এমনকী মানুষের ক্ষেত্রেও! ভেবে দেখো, কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে যে, “ ভাই অমুকের বাড়িটা কোথায় রে ? ” আমরা কিন্তু বলি না যে, “ওই ৫০০ মিটার হবে।” বরং আমরা বলি, “বেশি না, এই দশ মিনিটের হাঁটা পথ।” উল্টো দিক থেকে খুব জোরে হাওয়া দিলে, মৌমাছির কোনও ফুলে পৌঁছতে অনেক বেশি সময় লাগে। তাই যখন হাওয়া দেয়, একই দূরত্বের জন্য মাঝের অংশের নাচটা মৌমাছিরা অনেক বেশি সময় ধরে নাচে। তাই, অন্য মৌমাছিদেরও ফুলে পৌঁছাতে কোনও ভুল হয় না। অবাক করার মতো ব্যাপার ! তাই না ?
সূত্র : সুমন্ত্র সরকার, ব্র্যান্ডাইস ইউনিভার্সিটি, ম্যাসাচুসেটস, bigyan.org.in
সর্বশেষ সংশোধন করা : 12/21/2019