আমাদের বাসভূমি পৃথিবী, অন্য সাতটি গ্রহ এবং আরও কিছু জ্যোতিস্ক সূর্যকে কেন্দ্র করে সবসময় ঘুরছে। সূর্য এবং একে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান সকল জ্যোতিস্ক ও ফাঁকা জায়গা নিয়ে আমাদের সৌরজগত গঠিত। সৌরজগতের বেশির ভাগ জায়গায়ই ফাঁকা। আমাদের এই পৃথিবী দু’ভাবে ঘুরছে। পৃথিবী তার নিজ অক্ষের উপর পাক খাচ্ছে আবার সূর্যকে কেন্দ্র করে একবছরে একবার ঘুরে আসছে। পৃথিবীর এ ঘোরার ফলেই দিন-রাত হয়, ঋতু পরিবর্তিত হয়।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে তোমরা পৃথিবী, সূর্য ও চন্দ্রের কিছুটা পরিচয় পেয়েছ। ভোরবেলায় সূর্যকে পূর্ব দিগন্তেউঠতে দেখা যায়। ধীরে ধীরে এটি আমাদের মাথার উপরের দিকে উঠে আসে। সন্ধায় দেখ সূর্য পশ্চিম দিগন্তেডুবে যায়। রাত শেষে পরদিন ভোরে সূর্যকে আবার পূর্ব দিগন্তেউঠতে দেখ। পৃথিবী থেকে মনে হয় সূর্য পূর্ব থেকে পশ্চিমে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। আগের দিনের মানুষ সেটাই মনে করতেন। তবে বিজ্ঞানীরা এখন প্রমাণ করতে পেরেছেন যে আসলে সূর্য পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরে না। বরং পৃথিবীই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে।
সূর্য ইপৃথিবীর চারদিকে ঘু রছে এটা কেন আমাদের মনে হয়? তোমরা নিশ্চয়ই বাস, লঞ্চ বা রেলগাড়ীতে করে দূ রে বেড়াতে গিয়েছ? তোমরা কি একটা বিষয় খেয়াল করেছ? এগুলো যখন খুব দ্রত যায় তখন পাশের গাছপালা গুলো পেছনের দিকে ছু টছে বলে মনে হয়। আসলে রেলগাড়ী, লঞ্চ বা বাস সামনের দিকে চলছে কিন্ত ুমনে হয় এটি দঁ াড়িয়ে আছে। আর পাশের গাছপালা আসলে স্থির কিন্ত ুমনে হয় এগুলো পেছনের দিকে ছু টছে। পৃ থিবী আর সূ র্যে র ব্যাপারটি তেমনি। পৃথিবী সূর্য কেকেন্দ্র করে ঘুরছে কিন্তুপৃ থিবী থেকে আমাদের মনে হয় সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে।
মানুষ প্রাচীন কাল থেকেই সূর্য, চন্দ্র ও তাঁরা নিয়ে আগ্রহী ছিল। তবে সে সময় মহাকাশের এসব জ্যোতিস্ক পর্যবেক্ষণের যন্ত্রপাতি ছিল না। তাই খালি চোখে যেমনটি বোঝা যেত তেমনটাই তারা বিশ্বাস করতেন। তোমরা হয়তো জেনেছো যে, অ্যারিস্টটল দুই হাজার বছরেরও বেশিসময় আগে বড় বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন। তিনিও মনে করতেন পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘোরে। এখন থেকেপ্রায় দুই হাজার বছর পূর্বে বিখ্যাত গণিতবিদ ও জ্যোর্তিবিজ্ঞানী টলেমী জোরালোভাবে বলেন যে, পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই সবকিছু ঘুরছে। তার এই মতবাদ দীর্ঘদিন মানুষ বিশ্বাস করেছে। কিছু কিছু জ্যোর্তিবিদ টলেমীর মতবাদে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তুতার এই মতবাদকে কেউ ভুল প্রমাণিত করতে পারেননি।
এরপর কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩) নামে একজন জ্যোর্তিবিদ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সর্ম্পূণ নতুন মতবাদ নিয়ে আসেন। তিনি পৃথিবীকেন্দ্রিক মডেলের বদলে সূর্যকেন্দ্রিক মডেলের প্রস্তাব করেন। তার মডেলের মূল কথা হলো পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে। তিনি আরও একটি কথা নতুন কথা বলেন। সেটি হলো পৃথিবী তার নিজের অক্ষের ওপর আবর্তন করছে। পরবর্তীতে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও ও কেপলার কোপারনিকাসের এই মতবাদের পক্ষে প্রমান হাজির করেন। বর্তমানে সূর্যকেন্দ্রিক এই মডেল প্রমানিত এবং বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষ তা গ্রহন করেছে।
তোমরা জেনেছ সূর্য একটি নক্ষত্র। সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী আরও সাতটি গ্রহ ও অন্যান্য জ্যোতিস্ক ঘুরছে। সূর্য এবং একে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান সকল জ্যোতিস্ক ও ফাঁকা জায়গা নিয়ে আমাদের সৌরজগত গঠিত। সৌরজগতের বেশির ভাগ জায়গায়ই ফাঁকা।
সূর্যকে কেন্দ্র করে আটটি গ্রহ বিভিন্নদূরত্বে থেকে ঘূরছে। নিচে ঘূর্ণায়মান গ্রহগুলোর কক্ষপথ দেখানো হল এবং সৌরজগতের সদস্যদের পরিচয় দেওয়া হলো।
সূর্য:আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্রে রয়েছে সূর্য। সূর্য অন্যান্য নক্ষত্রের মতো জ্বলন্তএকটি গ্যাসপিন্ড। এই জ্বলন্ত গ্যাসপিন্ডে রয়েছে মূলতঃ হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস। হাইড্রোজেন গ্যাসের পরমাণু পরস্পরের সাথে সংযুক্ত হয়ে হিলিয়াম পরমাণুতে পরিণত হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়। এ শক্তি তাপ ও আলোকশক্তি হিসেবে সৌরজগতে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই সূর্যের কাছ থেকে আমরা তাপ ও আলো পেয়ে থাকি।
সূর্য মাঝারি আকারের একটি নক্ষত্র। তারপরও এটি পৃথিবীর তুলনায় লক্ষ লক্ষ গুণ বড়। সূর্য পৃথিবী থেকে প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তাই পৃথিবী থেকে আমরা সূর্যকে এত ছোট দেখি।
গ্রহগুলোর পরিচয়:সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে আটটি গ্রহ। পৃথিবী এমন একটি গ্রহ। গ্রহসমুহ সাধারণতঃ গোলাকাকৃতির। গ্রহগুলোতে বিভিন্ন গ্যাসীয় পদার্থ রয়েছে। কিন্তুগ্রহগুলো নিজেরা শক্তি উৎপাদন করে না। তাই কোন গ্রহ নিজে আলো বা তাপ নিঃসরণ করে না। পৃথিবীথেকে সূর্যের অন্যান্য গ্রহকে উজ্জ্বল দেখালেও এগুলো আসলে সূর্যের আলোতে আলোকিত। গ্রহগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় হলো
বুধ:বুধ সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ। এতে কোন বায়ু মন্ডল নেই। এটি ৮৮ দিনে সূর্য কে একবার প্রদক্ষিণ করে আসে।
শুক্র:পৃথিবী থেকে সন্ধায় পশ্চিম আকাশে সন্ধাতারা এবং ভোরবেলায় শুকতারা রূপে যে তারাটি দেখা যায় সেটি কোন নক্ষত্র নয়। এটি আসলে সূর্যের একটি গ্রহ যার নাম শুক্র। সূর্যের আলো এ গ্রহের উপরে পড়ে। তাই আমরা একে আলোকিত দেখি। এটি ৫৯ দিনে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে।
পৃথিবী:তোমরা হয়তো জান যে, কেবল পৃথিবীতেই জীবনেরজন্য উপযোগী উপকরণ ও পরিবেশ রয়েছে। পৃথিবী সূর্য থেকে দূরত্বের দিক দিয়ে তৃতীয় গ্রহ।
মঙ্গল:মঙ্গলকে কখনও কখনও লাল গ্রহ বলা হয় কারণ এর পৃষ্ঠ লাল রঙের। এর পৃষ্ঠ ধুলিময় এবং এর খুবই পাতলা বায়ুমন্ডল রয়েছে। মঙ্গলের মাটির নিচে পানি থাকার সম্ভাবনা আছে বলে বিজ্ঞানীরা এখন মনে করেন।
বৃহস্পতি :বৃহস্পতি সূর্যের সবচেয়ে বড় গ্রহ। এটিতে শুধু গ্যাসই রয়েছে, কোন কঠিন পৃষ্ঠ নেই।
শনি:শনি গ্রহটিও কেবল গ্যাস দিয়ে তৈরি। এটিকে ঘিরে কতগুলো রিং বা আংটা রয়েছে।
ইউরেনাস:ইউরেনাস গ্যাস ও বরফ দিয়ে গঠিত।
নেপচুন :নেপচুনও অনেকটা ইউরেনাসের মতো একটি গ্রহ।
আগে পুটো নামক একটি জ্যোতিস্ককে গ্রহ বলা হতো। কি ন্তু২০০৯ সালে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তনেন যে, এটি একটি ক্ষুদ্র অসম্পূর্ণ গ্রহ।
উপগ্রহ:
তোমরা জেনেছ সৌরজগতের গ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘোরে। তেমনি গ্রহগুলোকে কেন্দ্র করে ঘুরছে ছোট ছোট উপগ্রহ। পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ চাঁদ। এটি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। উপগ্রহগুলো আকারে গ্রহের চেয়ে অনেক ছোট হয়। এরাও নিজেরা তাপ বা আলো উৎপন্ন করতে পারে না। এরা তাই সূর্যের আলো দ্বারা আলোকিত হয়। সূর্যের আলো চাঁদের পৃষ্ঠে পড়ে প্রতিফলিত হয় বলে আমরা চাঁদকে আলোকিত দেখি।
চাঁদ ২৭ দিন ৮ ঘন্টায় একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। চাঁদ প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের আগ্রহের বস্তু। তোমরা দেখ যে চাঁদ একরাতে হয়তো একেবারেই দেখা যায় না। যাকে আমরা অমাবস্যা বলি। তার পরের রাতে সরু এক ফালি চাঁদ পশ্চিমা আকাশে অল্প সময়ের জন্য দেখা যায়। এই সরু এক ফালি চাঁদ প্রতি রাতে বড় হতে থাকে। দুই সপ্তাহ পর চাঁদকে একটি থালার মতো দেখা যায়। একে আমরা পূর্ণিমা বলি। পূর্ণিমার পরের রাত থেকে চাঁদটি আবার বা ছোট হতে থাকে। এভাবে ছোট হতে হতে আবার দুই সপ্তাহ পর চাঁদকে কোন এক রাতে এক বারের জন্যও দেখা যায়না। এভাবে ২৯ বা ৩০ দিন পর পর আমরা অমাবস্যা ও পূর্ণিমা হতে দেখি। কেন এরকম হয়? এ প্রশ্নের উত্তর তোমরা উপরের শ্রেণিতে জানবে।
চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃ তিক উপগ্রহ হলেও পৃ থিবীর চারপাশে ঘুরছে ২৫০০ এর বেশি মানুষ প্রেরিত উপগ্রহ। এদেরকে কৃ ত্রিম উপগ্র হ বলা হয়। এ কৃত্রিম উপগ্র হগুলো বেতার ও টেলিযোগাযোগ, আবহাওয়া এবং অন্যান্য তথ্য সংগ্র হের জন্য প্রেরণ করা হয়। পৃথিবীর মতো অন্যান্য গ্র হেরও প্রাকৃ তিক উপগ্রহ রয়েছে।
সৌরজগতে অন্যান্য জ্যোতিস্ক
আমাদের সৌরজগতে সূর্য , গ্রহ ও উপগ্র হ ছাড়াও রয়েছে অন্যান্য জ্যোতিস্ক। এরা হলো, ধু মকেতু , উল্কা ও গ্র হাণু । সূর্য কে কেন্দ্র করে এরা ঘু রছে। গ্রহের চেয়ে আকারে বেশ ছোট কঠিন শিলাময় বা ধাতব বস্তু - যাদের নাম গ্রহাণু। এরা ক্ষুদ্র গ্রহের মতো। ধু মকেতু সমু হও আমাদের সৌরজগতের অংশ। এরা কঠিন (গ্যাস, বরফ ও ধু লিকণা) পদার্থ দিয়ে তৈরি। তবে তা তাপ পেলে কিছু অংশ সহজেই গ্যাসে পরিণত হতে পারে। যখন ধু মকেতু সমুহ সূর্যে র কাছাকাছি যায় তখন সূ র্যে র তাপে গ্যাসীয় ও কঠিন পদার্থ নির্গ ত হয়ে আকাশে ছড়িয়ে যায়। তখন এটি ঝাটার মত দর্শ নীয় লেজে পরিণত হয়। পৃথিবী থেকে এদেরকে কখনও কখনও দেখা যায়। কোন কোন ধু মকেতু অনেক বছর পর পর পৃ থিবীর আকাশে দেখা যায়। যেমন, হ্যালির ধু মকেতু গড়ে ৭৫ বছর পরপর পৃ থিবী থেকে দেখা যায়। এটিকে ১৯১১ সালে এবং ১৯৮৬ সালে দেখা গেছে। একে আবার ২০৬২ সালে দেখা যাওয়ার কথা।
তোমরা কি কখনও রাতের বেলায় হঠাৎ আকাশে আগুনের গোলক ছুটে যেতে দেখেছ? এরা উল্কাপিন্ড। সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণায়মান জ্যোতিস্ক সমুহের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হলো উল্কাপিন্ড। এই ক্ষুদ্র কঠিন পিণ্ড পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পৌছালে বায়ুর সংস্পর্শে এসে পুড়ে যায়। এ জন্য এদেরকে অগ্নি গোলকের মতো ছুটে বা পড়ে যেতে দেখা যায়। কখনও কখনও বড় উল্কা পিণ্ড আধপোড়া অবস্থায় পৃথিবী পৃষ্ঠে পড়ে বড় গর্তের সৃষ্টি করে।
আমরা পৃথিবীতে বাস করি। আমাদের এই পৃথিবীর আকার কেমন? আমরা চারদিকে তাকালে কি এর আকার বুঝতে পারি? একে কি গোলাকার চাকতি বা থালার মতো মনে হয়? আপাত দৃষ্টিতে পৃথিবীকে একটি থালার মতো মনে হয়। মনে হয় আমরা আমাদের ঘরবাড়ি ঐ থালা বা চাকতির উপরে আছি। আর আকাশ এই থালাকে ঢেকে আছে। কিন্তুপৃথিবী থালা বা চাকতির মতো নয়। এটি গোলাকার তবে পুরোপুরি গোলাকার নয়। পৃথিবী কমলালেবুর মতো উত্তর দক্ষিণ দিকে কিছুটা চাপা।
গোলকাকার পৃথিবী পৃষ্ঠের চার ভাগের তিন ভাগ পানি আর একভাগ মাটি দিয়ে আবৃত। আর এই গোলকাকার পৃথিবীকে ঘিরে রয়েছে গ্যাসীয় বায়ুমন্ডল। তোমরা নিশ্চয়ই ভূ-গোলক বা গে−াব দেখেছো? এটি দেখলে পৃথিবী যে গোলকের মতো তা বোঝা যায়। আমরা ভূ-গোলকের মতো একটি গোলকের পৃষ্ঠে অবস্থান করছি। প্রশ্ন হলো আমরা তাহলে পৃথিবী থেকে দুরে ছিটকে বা পড়ে যাই না কেন ?
এর কারণ অভিকর্ষ বল। পৃথিবী তার পৃষ্ঠের সব কিছুকে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে টেনে ধরে এই বলের সাহায্যে। এর ফলে পৃথিবী পৃষ্ঠে অবস্থানকারী কোন কিছুই পৃষ্ঠ থেকে ছিটকে পড়ে না।
তোমরা দেখ সকালে সূর্য পূর্ব দিকে উঠে। সন্ধ্য বেলায় পশ্চিম দিগন্তে ডুবে যায়। পরদিন সকালে তোমরা দেখ যে সূর্য আবার পূর্বদিক থেকে উঠছে। এ থেকে মনে হয় পৃথিবীকে কেন্দ্র করে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ঘুরছে। আগের দিনে মানুষরা তাই ধারণা করতো যে পৃথিবী স্থির এবং সূর্য পৃথিবীরকে কেন্দ্র করে ঘোরে। প্রকৃতপক্ষে, পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘোরে এবং পৃথিবীর নিজ অক্ষের উপরও আবর্তন করে বা পাক খায়। তোমরা নিশ্চয়ই লাটিম নিয়ে খেলেছো? লাটিম কীভাবে ঘোরে? লাটিম তার সরু আল-এর উপর দাড়িয়ে নিজে নিজে পাক খায় বা আবর্তন করে। একই সাথে মাটির উপর বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকার পথে এক স্থান থেকে অন্য স্থান হয়ে ঘুরে আসে।
এভাবে লাটিমটির দু’ধরনের গতি রয়েছে। একটি হলো নিজ অক্ষের উপর আবর্তন। আরেকটি হলো মাটির উপর দিয়ে ঘুরে আসা। লাটিমের মতো পৃথিবীরও দুধরনের ঘূর্ণন রয়েছে। একটি হলো পৃথিবীর নিজ অক্ষের উপর কেন্দ্র করে ২৪ ঘন্টায় একবার পশ্চিম থেকে পূর্বে আবর্তন করে। এটিকে বলা হয় পৃথিবীর আহ্নিক গতি। দ্বিতীয়টি হলো পৃথিবী প্রায় ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টা সময়েএকবার সূর্যের চারপাশে ঘুরে আসে। একে পৃথিবীর বার্ষিক গতি বলা হয়। পৃথিবীর আহ্নিক গতির অর্থাৎ নিজ অক্ষে আবর্তনের কারণে দিন রাত হয়। দিন রাত কীভাবে হয় তা নিচের পরীক্ষাটির মাধ্যমে ভালভাবে বোঝা যায়।
পরীক্ষণ : পৃথিবীর আহ্নিক গতির পরীক্ষা - দিনরাত কীভাবে হয়?
উপকরণ : একটি ভু-গোলক, একটি মোমবাতি অথবা কুপিবাতি অথবা চার্জ লাইট।
পরীক্ষণ প্রণালী:প্রথমে ভূগোলকটি ভালভাবে লক্ষ কর। এর মাঝ বরাবর একটি শলাকা এক প্রান্তথেকে অন্য প্রান্তেচলে গেছে। এটিকে পৃথিবীর অক্ষরেখা হিসেবে কল্পনা কর যাকে কেন্দ্র করে পৃথিবী আবর্তন করে ।
একটি টেবিল বা সমতল মেঝের উপর বাতিটি জ্বালিয়ে রাখ। এবার একটু দূরে ভূ-গোলকটিকে রাখ। কক্ষটির আলো নিভিয়ে বা দরজা জ্বানালা বন্ধ করে ঘরটি অন্ধকার কর। বাতিটিকে সূর্য এবং ভূ-গোলকটিকে পৃথিবী হিসেবে বিবেচনা কর। এবার ভূ-গোলকটির দিকে তাকাও। ভূ-গোলকটির সবদিক কিসমান আলোকিত? না কোন দিক আলোকিত আর তার উল্টো দিক অন্ধকারাচ্ছন্ন? দেখতে পাচ্ছো নিশ্চয়ই যে ভূ-গোলকটির অর্ধেক অংশ আলোকিত আর অন্য অর্ধেক অন্ধকারাচ্ছন্ন। কোন অর্ধেক আলোকিত? যে অর্ধেক বাতিটির দিকে আছে । আমরা আলোকিত অংশকে দিন আর অন্ধকারাচ্ছন্ন অংশটিকে রাত মনে করতে পারি। এবার ভূ-গোলকটি আস্তে আস্তে ঘোরাও এবং লক্ষ করে দেখ কী হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে অন্ধকার অংশ আস্তে আস্তে আলোকিত হ্েচ্ছ এবং আলোকিত অংশ ধীরে ধীরে অন্ধকার হচ্ছে । কিন্তুসবসময়ই ভূ-গোলকটির অর্ধেক অংশ আলো পাচ্ছে এবং বাকি অর্ধেক অংশ আলো পাচ্ছে না । এভাবে পৃথিবীর এবং অর্ধেকাংশে দিন এবং বাকী অর্ধেক রাত চলতে থাকে । ভূ-গোলকটির একটি নির্দিষ্ট স্থান বাতিটির সামনে রেখে ধীরে ধীরে একদিকে ঘোরাতে থাকলে ঐ আলোকিত অংশ (দিন) ধীরে ধীরে অন্ধকার হতে হতে একসময় পুরোপুরি অন্ধকার (রাত) হয়ে যাবে। একই দিকে আরও ঘোরাতে থাকলে আবার ঐ নির্দিষ্ট স্থানটি আলোকিত হতে শুরু করে এবং একসময় পুরোপুরি আলোকিত হয়ে যায় । অর্থাৎ ঐ স্থানে আবার দিন ফিরে আসে।
এই পরীক্ষাটির মতো পৃথিবী তার নিজ অক্ষে আবর্তন করে, ফলে আমরা দিন, তারপর রাত, আবার দিন, আবার রাত, আবার দিন এই রকম পরিবর্তন হতে দেখি। অন্যকথায়, দিন-রাত-দিন-রাত-দিন এই পরিবর্তন আমরা দেখি কারণ পৃথিবী তার নিজ অক্ষে আবর্তন করে বলে।
ইতোমধ্যে তোমরা পৃ থিবীর আহ্নিক গতি বা নিজ অক্ষের উপর আবর্ত ন সম্পর্কে জেনেছা। পৃ থিবীর অন্য গতিটি হচ্ছে বার্ষি ক গতি। পৃথিবী সূর্য কে কেন্দ্র করে প্রায় ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা সময়ে একবার ঘুরে আসে । এই সময়কে এক সৌর বছর বা এক বছর বলা হয় । পৃথিবীর বার্ষি ক গতির ফলে দিন রাত ছোট বা বড় হয় এবং ঋতু র পরিবর্ত ন হয়।
তোমরা কী বছরের সবসময় একই রকমের আবহাওয়া দেখতে পাও? জানুয়ারী মাসে বা পৌষ-মাঘ মাসে শীত না গরম থাকে? আষাঢ় বা ভাদ্র মাসে আবহাওয়া কি পৌষ মাসের মতোই না ভিন্ন ? আমরা দেখি ভারতবর্ষ বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম আবহাওয়া থাকে । পৌষ বা মাঘ মাসে বেশ শীত পড়ে আবার বৈশাখ বা জ্যৈষ্ঠ মাসে বেশ গরম পড়ে। কেন, তা ভাবো তো? এইসব প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে কীভাবে ঘোরে তা জানলে। পৃথিবী সূ র্যে র চারপাশে কিছু টা হেলে সূর্য কে প্রদক্ষিণ করে। তবে পৃথিবী বছরের বিভিন্ন সময়ে তার হেলানো অবস্থান পরিবর্ত ন করে। তাই পৃথিবীর একটা নির্দি ষ্ট অংশ একটি নির্দি ষ্ট সময় সূর্যের দিকে মু খ করে থাকে । পৃথিবীর একটি নির্দি ষ্ট অংশ যখন সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে তখন সেই অংশটি বেশিক্ষণ ধরে এবং খাড়াভাবে সূ র্যে র তাপ পায়। পৃথিবীর সেই অংশে তখন গ্র ীষ্মকাল। তোমরা হয়তো জান যে, পৃ থিবীর বিষু ব রেখার দু ই পাশ্বর্ কে দু টি গোলার্ধে ভাগ করা হয়। উত্তর অংশকে উত্তর গোলার্ধ এবং দক্ষিণঅংশকে দক্ষিণ গোলার্ধ ধরা হয় । আমরা উত্তরগোলার্ধে বাস করি। ২১ জুন তারিখে ভারতবর্ষ সূর্যের কিছু টা কাছে চলে আসে। তাই এসময়ে আমরা সুর্য কে আমাদের মাথার উপর দেখতে পাই। এই সময়ে আমরা সবচেয়ে লম্বা দিন ও ছোট রাত দেখতে পাই। খাড়াভাবেএবং লম্বা সময় সূর্যের তাপ পাওয়ার কারণে এই সময়টিতে এবং এর কাছাকাছিসময়ে ভারতবর্ষ বেশ গরম পড়ে। তবে মৌসুমী বায়ু র প্র ভাবে এই সময়ে ভারতবর্ষ আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে আমরা এই সময়টিকে বর্ষাকাল বলে থাকি ।
২১ জুন পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ সূর্য থেকে দূরে অবস্থান করে। তাই দক্ষিণ গোলার্ধে তখন রাত বড় হয়, দিন ছোট হয় এবং ওখানে সূর্যের তাপ তির্যক বা হেলানো ভাবে পড়ে। ফলে দক্ষিণ গোলার্ধ এ সময় সূর্যের তাপ কম পায়। ওখানে তখন শীতকাল। যেমন অস্ট্রেলিয়ায় জুন, জুলাই ও আগস্ট এই তিন মাস শীতকাল।
পৃথিবী ২১ জুনের পরে তার হেলানো অবস্থান পরিবর্তন করতে থাকে। ভারতবর্ষহ উত্তর গোলার্ধ কিছুটা দূরে সরে যেতে থাকে, একই সাথে দক্ষিণ গোলার্ধ কিছুটা সূর্যের দিকে এগোতে থাকে। এইভাবে সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখে পৃথিবীর বিষুব অঞ্চল সুর্যের দিকে মুখ করে থাকে এবং উত্তর ও দক্ষিণ মেরু ঐ সময়ে সুর্য থেকে সমান দূরত্বে থাকে । সেপ্টেম্বর ২৩ তারিখে তাই পৃথিবীর উভয় গোলার্ধে দিন রাত সমান হয়। বিষুবীয় অঞ্চলে তখন সূর্য মাথার উপরে অবস্থান করে খাড়াভাবেকিরণ দেয়, তখন বিষুবীয় অঞ্চলে বেশ গরম পড়ে। ভারতবর্ষ তখন দিন-রাত সমান বলে তখন শীতও নয় আবার খুব গরমও নয়। দক্ষিণ গোলার্ধেও তখন শীত চলে গিয়ে গ্রীষ্মকাল আসতে থাকে অর্থাৎ সেখানে তখন বসন্ত।
২১ ডিসেম্বর দক্ষিণ গোলার্ধের একটি অংশ সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। আর তখন ভারতবর্ষ সূর্য থেকে দূরে অবস্থান করে। তাই তখন ভারতবর্ষ দিন ছোট হয় এবং রাত বড় হয়। সূর্যকে দেখ দক্ষিণ দিকে হেলে কিরণ দিতে। কম সময় এবং তির্যকভাবে কিরণ পায় বলে তখন শীত পড়ে। পক্ষান্ত রে, দক্ষিণ গোলার্ধের অস্ট্রেলিয়ায় তখন দিন বড় এবং রাত ছোট হয়। সূর্য তখন দক্ষিণ গোলার্ধে খাড়া ভাবে কিরণ দেয়। তাই দক্ষিণ গোলার্ধে তখন গ্রীষ্মকাল।
আবার পৃথিবী ২১ মার্চ সূর্যের দিকে মুখ করে হেলে থাকে। তখন আবার পৃথিবীর সকল স্থানে দিনরাত সমান হয়। এজন্য এই সময়ে আমাদের দেশেও দিনরাত সমান হয়। এইসময়ে শীতও বেশি থাকে না আবার গরমও বেশি পড়ে না। এই সময়ে আমাদের দেশে বসন্তকাল। ২১ মার্চের পরে পৃথিবী আবার ঘুরতে ঘুরতে ২১ জুন তারিখে আগের বছরের অবস্থানে ফিরে আসে। এভাবে সূর্যের দিকে পৃথিবীর অবস্থানেরতারতম্যের কারণে দিন রাত ছোট বা বড় হয়। এবং এর ফলস্বরূপ ঋতু পরিবর্তিত হয়। পৃথিবী যদি সূর্যের চারদিকে না ঘুরতো তাহলে কী হতো ভাবো তো? পৃথিবী সূর্যের চারদিকে না ঘুরলে পৃথিবীর কোন একটি জায়গায় সবসময় একটি ঋতুই থাকতো।
রাশিয়া বা অন্যান্য শীতপ্রধান দেশে ঋতু পরিবর্তন না হলে মানুষ বাঁচতেই পারতো না। সেখানে বছরের বেশির ভাগ সময় বরফ ঢাকা থাকে। সেসময় ফসল ফলে না। অল্প সময় গ্রীষ্মকাল এলে বরফ গলে যায়। মানুষ তখন ফসল ফলায়। গ্রীষ্মকাল না এলে মানুষ ফসল ফলাতে পারতো না।
সূত্র: বিজ্ঞান পত্রিকা
সর্বশেষ সংশোধন করা : 12/27/2022