আধুনিক জীবনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ অন্যতম সেরা আরামদায়ক ব্যবস্থা। কিন্তু এটি আবার খলনায়কও বটে। তার কারণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সচরাচর বাতাসে বেশ ভালো পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়। বিশ্বে উষ্ণায়ন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ক্রমশ জরুরি হয়ে পড়ছে। আরামের জন্য তো বটেই, খাদ্যসামগ্রী সংরক্ষণের জন্যও এই ব্যবস্থা থাকাটা খুবই জরুরি। প্রথম এই ব্যবস্থার ভিতর দিয়েই কিন্তু বিদ্যুৎ ব্যবহার কমানোর প্রক্রিয়া শুরু করা গিয়েছে।
জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে ভূপৃষ্ঠের অন্তরালে থাকা সংরক্ষিত ভূ-তাপকে ব্যবহার করে চিরাচরিত জ্বালানির ব্যবহার কিছুটা কমানো হচ্ছে। ঠিক সেই রকম ভাবেই বর্হি-অন্তরীক্ষের বরফি ঠান্ডাকে কাজে লাগিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোরও চেষ্টা চলছে। কী ভাবে অপটিকাল আমব্রেলা বা অপটিকাল ছাতা ব্যবহার করে জিনিসপত্রকে বিকিরণ ড্রেনপাইপের মাধ্যমে ঠান্ডা রাখা যায় সেই পদ্ধতি নিয়ে সম্প্রতি নেচার পত্রিকায় লিখেছেন আমেরিকার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অশ্বথ পি রমন, মার্ক আবাউ আনোমা, লিনক্সিয়াও ঝু, ইডেন রাফায়েলি এবং শানহুই ফান।
এর আগে রাতের আবহাওয়াকে ব্যবহার করে পরের দিনের তাপমাত্রাকে কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছিল। এর একটা পদ্ধতি হল, ছাদে তাপ পরিবর্তক বা হিট এক্সচেঞ্জার বসানো যা রাতের বেলায় জল ধরে ঠান্ডা রাখবে তার ফলে দিনের বেলার তাপ অনেকটা কমানো যায়। সত্যিকারের বিকিরণ রেফ্রিজারেটরও বেরিয়ে গিয়েছে। এ ধরনের রেফ্রিজারেটরে রাতের বেলা রেডিয়েটরটির উপর থেকে ৮ থেকে ১৩ মাইক্রোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘের তাপ বেরিয়ে যায়। এই তাপ বায়ুমণ্ডলে শোষিত হয় না, ফলে এটি আবহাওয়ামন্ডলের বাইরে চলে যায়। কিন্তু এই পদ্ধতি দিনের বেলা চালু করা সম্ভব নয়। তার কারণ তখন রেডিয়েটিং সারফেস বা বিকিরণের তলটি সূর্যের আলোর তুলনায় গরম থাকে। কিন্তু স্ট্যানফোর্ডের এই দলটি দেখিয়েছে, এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব যাতে সরাসরি সূর্যের আলোয় দাঁড় করিয়ে দিলে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা কমানো সম্ভব।
এর তত্ত্বটি হল, ভূ-পৃষ্ঠে সমস্ত জিনিস বিকিরণের মাধ্যমে ঠান্ডা হয় কিন্তু মাটি সূর্যের আলো ও পারিপার্শিক পরিমণ্ডল থেকে তাপ শোষণ করে। বিকিরণ তল থেকে যে তাপ বের হয় তা-ও মাটিতে শোষিত হয়। কিন্তু এই তল যদি বেশির ভাগ হাল্কা জিনিস নির্গত করে এবং তল থেকে নির্গত তাপ আবহাওয়ায় না মিশে বের হয়ে যায় তা হলে তাপ বের হয়ে ঠান্ডা অবস্থার সৃষ্টি হয়। কিন্তু সাধারণ তাপমাত্রায় বস্তু থেকে তাপ বিকিরণের পরিমাণ খুব কম, এবং তা সঙ্গে সঙ্গে শোষিত হয়ে যায়। সূর্য থেকে পাওয়া ঘটমান শক্তি অনেক বেশি থাকায় বস্তু ঠান্ডা হতেও সময় নেয়। এর বিপরীতাবস্থার জন্য প্রতিফলন ক্ষমতা ৯৪ শতাংশ হতে হবে। একই সঙ্গে তল থেকে নির্গত বিকিরণের জোরালো ও সরু তরঙ্গদৈর্ঘ হতে হবে যাতে তা আশপাশের আবহাওয়া পরিমণ্ডলে না মেশে। এই যুগলাবস্থার সৃষ্টি খুবই কঠিন কাজ। ধাতব ফয়েল প্রতিফলকের মাধ্যমে সূর্যের বিকিরণ কমানো এবং সাধারণ প্রতিফলকের মাধ্যমে সূর্যালোকে ঠান্ডা করার প্রক্রিয়া এ পর্যন্ত সাফল্যলাভ করেনি। সব চেয়ে বড় কথা হল, আশপাশের ঝঞ্ঝাট থেকে ব্যবস্থাটিকে নিরাপদ রাখতে হবে। কুলার যন্ত্রের সঙ্গে থাকা যে কোনও জিনিস সূর্যের আলোয় গরম হয়ে যায় এবং কুলারটিকেও সেই একই পরিণতির দিকে ঠেলে দেয় অর্থাৎ সেটিও গরম হয়ে যায়।
নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধটিতে বলা হয়েছে, একটি দ্বিমাত্রিক ন্যানো-কাঠামোর সাহায্যে বিকিরণকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং এর মাধ্যমে চাহিদামতো নির্গমণ ও প্রতিফলন পাওয়ার ব্যবস্থা করা সম্ভব। কিন্তু প্রস্তাবিত এই কাঠামোর জন্য খুবই সুক্ষ্ম যন্ত্রপাতি ও জটিল কারিগরির প্রয়োজন। বর্তমানে যন্ত্রটিতে যে নকশা ব্যবহার করা হয়েছে তার উপর একমাত্রিক ফিল্ম আর্কিটেকচার ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে নির্গমণ মাপা খুবই সহজ হয়। কুলারটি একটি যন্ত্রের মধ্যে বসানো থাকছে যাতে তাপের হাত থেকে তাকে রক্ষা করা যায় এবং রৌদ্রালোকে প্রকৃত তাপমাত্রা কমে যায়।
প্রতিফলক-নির্গমকে হাফনিয়াম ডাই অক্সাইড ও সিলিকন ডাইঅক্সাইডের সাতটি স্তর রয়েছে। এটি ২০০ মিলিমিটার রূপার ভিত্তির উপর বসানো। যেটি আবার সিলিকন ওয়াফারের মধ্যে বসানো। মাপ করে অক্সাইডের স্তরগুলি স্থির করা হয়েছে, যাতে পরপর উচ্চ ও কম ক্ষমতার প্রতিফলক সূচক থাকে। তলার চারটি স্তর মোটা সমগ্র সৌর-বিচ্ছুরণের মধ্যে থেকে এই অংশটি সব চেয়ে বেশি প্রতিফলকের কাজ করে। উপরের তিনটি স্তর অপেক্ষাকৃত সরু। এই স্তরগুলি প্রাথমিক ভাবে নিয়ন্ত্রিত নির্গমনের কাজ করে। দ্রব্যগুণ ও অপটিকাল এফেক্টের দরুন সিলিকন ডাইঅক্সাইড ৯মাইক্রোমিলি তরঙ্গদৈর্ঘের এবং হাফনিয়াম ডাইঅক্সাইড ৯.১৩ মাইক্রোমিলি তরঙ্গদৈর্ঘের তাপ নির্গমণ করে। সাতটি স্তর সম্মিলিত ভাবে অত্যন্ত উচ্চমানের প্রতিফলন করে যার জন্য সূর্যরশ্মির বিকিরণ অত্যন্ত কম হয় এবং সব চেয়ে উচ্চ দৈর্ঘের তরঙ্গ নির্গমণ করে যা আবহাওয়া মণ্ডলে শোষিত হয় না। এর প্রতিক্রিয়া হল— কুলারটি সূর্যের আলোয় গরম হচ্ছে না এবং সেটি বিকিরণকে মুক্ত করার ব্যাপারেও একটি ভূমিকা নিচ্ছে। এই বিকিরণ আবহাওয়ায় শোষিত না হয়ে মহাকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে। এখানে হাফনিয়াম ডাইঅক্সাইডের পরিবর্তে সস্তার টাইটেনিয়াম ডাইঅক্সাইডও ব্যবহার করা যেতে পারে।
কুলারের অবস্থান এমন ভাবে রাখতে হবে যাতে আশপাশ থেকে তাপ প্রবেশ না করে। সিলিকনের মোড়ক দেওয়া কুলিং স্ট্যাকটিকে আবার একটি পলিস্টাইরিন নির্মিত হোল্ডারের উপর রাখা হয়। যে হোল্ডারটিকে ধারণ করে একটি কাঠের ফ্রেমে বসানো অ্যাক্রিলিকের বাক্স। কুলারটির উপর একটি পলিথিলিন ফিল্মের মোটা চাদর থাকে, যেটি ইনফ্রা রেড বিকিরণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ। তবে এটি বাতাসকে কুলারে ঢুকতে দেয় না। এ ভাবে কুলারটিকে সম্পূর্ণ বাতাসমুক্ত করে বড় ছাদে এমন ভাবে রাখা হয় যাতে কোনও ভাবেই আশপাশের তাপ এর ভিতর প্রবেশ করতে না পারে, অর্থাৎ বাইরের বিকিরণের প্রকোপ থেকে একে মুক্ত রাখতে হয়। প্রতিফলন ও নির্গমণ সংক্রান্ত পরীক্ষামূলক ব্যবহারে দেখা গিয়েছে, সূর্যছটার মাধ্যমে ৯৭ শতাংশ প্রতিফলন হচ্ছে, ৩০০ ন্যানো মিটার থেকে ৪ মাইক্রোমিলি তরঙ্গদৈর্ঘের বেশ জোরদার নিয়ন্ত্রিত নির্গমণ হচ্ছে।
সকাল দশটার কিছু আগে স্ট্যানফোর্ডের ছাদে ‘প্যাসিভ কুলিং’ নামে এই যন্ত্রটির পরীক্ষামূলক প্রদর্শন করা হয়েছে। সূর্যালোকে এটিকে রাখামাত্র এর তাপমাত্রা চার-পাঁচ ডিগ্রি কমে গিয়েছিল। প্রবন্ধটির রচয়িতাদের মন্তব্য, ‘‘বিকিরণের মাধ্যমে ঠান্ডা করার ব্যবস্থার এটি আদর্শ উদাহরণ। সচরাচর আমরা জানি কোনও জিনিসকে শেডের তলা থেকে রৌদ্রে আনা মাত্র তার তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এর ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো।’’ এটিকে সূর্যের আলোয় বহুক্ষণ রেখে দেওয়া হয়েছিল। সর্বক্ষণই এটি আশপাশের চেয়ে চার-পাঁচ ডিগ্রি তাপ কমিয়ে দিয়েছে। বাইরে থেকে তাপপ্রয়োগ করে কতটা তাপমাত্রা কমছে তার হিসাব কষা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে প্রতি বর্গমিটারে ৪০ ওয়াট ফলাফল আসছে। সৌরকোষের মাধ্যমে সৌরালোককে শোষণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় কিন্তু এখানে সরাসরি ১০০ ওয়াট প্রতি বর্গমিটার পর্যন্ত তাপ নির্গমণ সম্ভব।
‘‘সরাসরি ঠান্ডা করার ব্যবস্থা করা উষ্ণায়িত বিশ্বের জন্য খুবই জরুরি, কারণ দেখা গিয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে গিয়ে কার্বন ডাইঅক্সাইডের নির্গমণ ক্রমশ বাড়ছে। মনে করা হচ্ছে আগামী দিনে তাপ নির্গমণের হারের চেয়ে কার্বন ডাইঅক্সাইডের নির্গমণের হার তূলনামূলক ভাবে বেশি হবে। উন্নয়নশীল বিশ্বে যেখানে গ্রিড ব্যবস্থার মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি সেখানে দিনের বেলায় বিকিরণের মাধ্যমে ঠান্ডা করার ব্যবস্থা বিদ্যুৎবিহীন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ এনে দিচ্ছে যার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য ও ওষুধ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। আরও বড় করে দেখলে বলা যায়, আমাদের এই আবিষ্কার দেখাচ্ছে, মহাবিশ্বের শীতল অন্ধকারের অজানা দুনিয়া পৃথিবীর শক্তি সংরক্ষণের জন্য মৌলিক পুনর্নবীকরণযোগ্য তাপগতির (থার্মোডায়নামিক) উৎস হতে পারে”, লিখেছেন প্রবন্ধ রচয়িতারা।
সূত্র : এস অনন্তনারায়ণন, দ্য স্টেটসম্যান, ৩ ডিসেম্বর ২০১৪।
লেখকের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য-simplescience@gmail.com
সর্বশেষ সংশোধন করা : 5/20/2020