ছাই ফেলতে পুকুর ছিল। কিন্তু সেটি এতই ছোট যে, ভাঙা কুলোরই সামিল। তার ছাই উপচে পড়ায় দু’ দু’টো নদী ভরে গিয়েছে। আর বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সেই ছাইয়ের দূষণে দু’টি নদী থেকে হারিয়ে গিয়েছে জীববৈচিত্র।
নদী বিশেষজ্ঞ এবং রাজ্য দূষণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্রের কাছ থেকে এই রিপোর্ট পেয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় পরিবেশ আদালত। কী ভাবে অই নদী দু’টিতে পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা যায়, তার রূপরেখা সহ হলফনামা দিতে বলল আদালত।
দু’সপ্তাহের মধ্যে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষকে হলফনামা দিতে হবে। ওই দু’টি নদী এবং তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ কী ভাবে নষ্ট হয়েছে, সেই বিষয়ে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকেও এক মাসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই থেকে ওই এলাকার চন্দ্রভাগা নদী ও বক্রেশ্বর নদের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এই নিয়ে কলকাতায় জাতীয় পরিবেশ আদালতের পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চে মামলা দায়ের করেছিলেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। তার ভিত্তিতেই ওই আদালতের বিচারপতি প্রতাপ রায় এবং বিশেষজ্ঞ সদস্য পি সি মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ কল্যাণবাবুকে রিপোর্ট দিতে বলেছিল। রিপোর্ট পেয়েই এ দিন হলফনামার নির্দেশ দেওয়া হয়।
কী বলা হয়েছে ওই রিপোর্টে ?
কল্যাণবাবু জানিয়েছেন, বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই ফেলার জন্য একটি পুকুর আছে চন্দ্রভাগা নদীর গা ঘেঁষে। ২০১৪ সালের জুন থেকে নভেম্বরের মধ্যে সেই পুকুর থেকে দু’লক্ষ ৪৭ হাজার ঘনমিটার ছাই চন্দ্রভাগা নদীতে এসে পড়েছে। তার জেরে দূষিত হয়েছে নদীর জল। পরিণামে ওই নদীর জলে বেড়ে ওঠা বিভিন্ন প্রজাতির জীবকুল পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।
তবে শুধু জলজ প্রাণিকুল নয়, দূষণে বিপন্ন হয়ে পড়েছে স্থানীয় জনজীবনও। তিনি লিখেছেন, ওই এলাকার একটি বড় অংশের মানুষ নদীর জল পান করতেন। স্নানও করতেন নদীতে। সুমি হাঁসদা নামে এক বৃদ্ধাকে উদ্ধৃত করে রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘নদীর জলে এত ছাই ভাসে যে, এলাকার বাসিন্দারা ওই জল ছুঁতেই পারেন না।’
এই পরিস্থিতিতে এক নদী বিশেষজ্ঞের মন্তব্য, “দূষণের জেরে একটি নদী থেকে জীবকুল হারিয়ে যাওয়া খুবই খারাপ সংকেত। নদী থেকে ছাই তুলে হয়তো জল দূষণমুক্ত করা যাবে। কিন্তু বিলুপ্ত জীবকুলকে ফিরিয়ে আনা খুবই কঠিন কাজ।”
দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রের খবর, এই মামলার শুনানির শুরুতেই নদী থেকে ছাই তুলে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিল পরিবেশ আদালত।
কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেই কাজ যথাযথ ভাবে হয়নি। এলাকা পরিদর্শনের পরে কল্যাণবাবু তাঁর রিপোর্টে সুপারিশ করেছেন, বিপন্ন নদীকে পুরোপুরি দূষণমুক্ত করতে গেলে এখনও দু’লক্ষ ঘনমিটার ছাই তুলতে হবে। এবং তা করতে হবে বর্ষার আগেই।
ছাই থেকে আবার যাতে সমস্যা না হয়, তার জন্য কিছু পরামর্শও দিয়েছেন নদী বিশেষজ্ঞ। তার মধ্যে আছে ---
ভবিষ্যতের কথা ভেবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষকে বর্জ্য পরিশোধন যন্ত্র বসাতে হবে।
কাটতে হবে নতুন ছাইপুকুর।
দূষণ রুখতে জেলা প্রশাসন, সেচ দফতর এবং বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ‘মনিটরিং কমিটি’ গড়া যেতে পারে।
রাজ্যের পরিবেশ দফতরের এক কর্তার মতে, “ওই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত বর্জ্য নদীতে মেশা আটকাতে না পারলে দূষণ ঠেকানো সম্ভব নয়।”
নদীবক্ষ থেকে ছাই তোলার ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে বলে জানিয়েছেন মামলার আবেদনকারী সুভাষবাবু। তাঁর বক্তব্য, অনেক সময়েই পে লোডার দিয়ে ছাই তোলা হয়। কিন্তু পে লোডার দিয়ে ছাই তোলা হলে নদীর ভূ-প্রাকৃতিক গঠন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরাও। আগামী এপ্রিল এই মামলার পরবর্তী শুনানি হবে।
সূত্র : নিজস্ব সংবাদদাতা, আনন্দবাজার পত্রিকা,২০ মার্চ ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/29/2020