শক্তিই হচ্ছে মানব সভ্যতার প্রধান চালক। মানুষ শক্তির মাধ্যমেই মূলতঃ উৎপাদন করে থাকে। সকল কাজের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে শক্তি। কিন্তু প্রচলিত শক্তির উৎসের সঞ্চয় খুবই সীমিত এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে সঞ্চয় ভাণ্ডার ক্রমশই ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাই আগামী প্রজন্মকে রক্ষার জন্য শক্তির নতুন উৎস সন্ধান খুবই জরুরি। বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে শক্তির বিকল্প উৎসের খোঁজে নানা গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেছেন। আগামী দিনের সম্ভাবনাময় এসব বিকল্প শক্তির উৎস নিয়ে এবারের বিজ্ঞানবিশ্ব আয়োজনটি সাজানো হয়েছে।
পারমাণবিক শক্তিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ছোট আকারের একটি পরমাণু কেন্দ্র হতে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব। মূলত নিউক্লিয়ার বিভাজন বা সংযোজন পদ্ধতিতে যে বিপুল তাপের উদ্ভব ঘটে, সেই পরিমাণ তাপকে পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্রে জলর বাষ্পীভবনের কাজে লাগানো হয়। উত্তপ্ত বাষ্প বা স্টিম টারবাইনকে ঘোরায় এবং টারবাইন ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে সংযুক্ত জেনারেটরও ঘুরতে শুরু করে। আর এর ফলে বিদু্যৎ উৎপন্ন করা যায়। তবে এ ব্যবস্থাটি যেমন জটিল ও ব্যয় সাপেক্ষ, তেমনি যেকোনো ধরনের অসাবধানতা পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করতে পারে।
জলর স্রোত বা প্রবহমান জল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। নদী, সাগর এমনকি জোয়ার-ভাটার স্রোতকে কাজে লাগিয়ে এবং খালের মতো কৃত্রিম জলপথে প্রবাহ তৈরি করে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদু্যৎ উৎপাদন করা সম্ভব। এতে কোনো ধরনের দূষণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
সূর্যই হচ্ছে সকল শক্তির উৎস। সৌরবিদু্যৎতন্ত্র তার ফটোভোল্টিক কোষের বিদু্যৎ শক্তিতে পরিণত করে। সোলার ওয়াটার হিটার যন্ত্রে জল গরম করতে তাপ সংগ্রাহক প্যানেল ব্যবহার করা হয়। সৌরশক্তি অফুরন্ত, সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব এবং নবায়নযোগ্য। একটি উদাহরণের মাধ্যমে সৌরবিকিরণ থেকে প্রাপ্ত সৌরশক্তির বিপুল সম্ভাবনা বোঝানো যাবে। সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে এক বছরে যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন হয়, তা বত্রিশ মিনিটে যে পরিমাণ সৌরবিকিরণ ঐ দেশে পড়ে, তার থেকে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সৌরবিকিরণে প্রাপ্ত সৌরশক্তিকে ব্যবহার উপযোগী করে তোলার উপযুক্ত প্রযুক্তি এখনও করায়ত্ব হয়নি। তবে উন্নত দেশগুলোতে সৌরশক্তিকে কিভাবে সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করা হচ্ছে।
সৌরখামার থেকে দুটি উপায়ে প্রচুর পরিমাণে বিদু্যৎ উৎপাদন করা সম্ভব। প্রথমত, সৌরতাপ পস্নান্টগুলোতে আয়না দিয়ে সূর্যের আলোকে ঘনীভূত করা হয়। এ পদ্ধতিতে জল থেকে তৈরি করা বাষ্প দিয়ে টারবাইন ঘোরানো হয়।দ্বিতীয়ত, আলোক কোষ ব্যবহার করে সরাসরি সূর্যশক্তি থেকে বিদু্যৎ উৎপাদন করা হয়।
তবে, এ পদ্ধতিতে কিছু সমস্যা রয়েছে। কারণ, সূর্য সব সময়ের জন্য আকাশে থেমে থাকে না। রাতে বা মেঘলা দিনে এর থেকে সরবরাহ পাওয়া যাবে না। এ ছাড়া রয়েছে বিনিয়োগের সমস্যা। কারণ, এ ধরনের খামার তৈরি করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়।
প্রতিটি বাড়িতে নিজস্ব বিদু্যৎ সরবরাহের জন্য বাড়ি বাড়ি ছোট আকারের টারবাইন লাগিয়ে বিদু্যৎ তৈরির পস্নান্ট তৈরি করা যেতে পারে। এ ধরনের পস্নান্ট হতে ১-২৫ কিলোওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদন করা সম্ভব। বায়ুশক্তির মাধ্যমে ৮০ ফুট টাওয়ারের উপর ১০ থেকে ২৫ ডায়ামিটার পাখা স্থাপন করলে জলর মোটর চালানোসহ বাতি জ্বালানো ও অন্যান্য কাজ করা সম্ভব। তবে এর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শব্দদূষণ।
বায়ুশক্তি থেকে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদনের কেন্দ্র সর্বপ্রথম ডেনমার্কে স্থাপিত (১৮৯০ সালে) হয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বায়ুশক্তি দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বায়ুচালিত জেনারেটর ঘোরানো হচ্ছে। দেশটিতে বায়ুশক্তি ব্যবহার করে ১৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। ২০৩০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মোট চাহিদার পাঁচ ভাগের এক ভাগ বায়ুশক্তির সাহায্যে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দিয়ে মেটানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আবার, ডেনমার্কের মোট শক্তির বিশ শতাংশ মেটানো হয় বায়ুশক্তিকে ব্যবহার করে। শক্তির এ উৎসটি পরিবেশবান্ধব ও নবায়নযোগ্য। তবে, এ ধরনের বায়ুখামারে চালিত টারবাইন পক্ষীকুলের চলার পথে বাধা সৃষ্টি করে, যা স্থানীয় পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
ভূ-ত্বকের নিচে প্রচুর পরিমাণে শক্তি জমা আছে। ভূ-তাপীয় শক্তি বর্তমানে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের একটি অন্যতম উৎস। এই ভূ-উত্তাপ শক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট উষ্ণ রাখার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রায় আট হাজার মেগাওয়াট ভূ-উত্তাপ শক্তি উৎপাদিত হচ্ছে। এর মধ্যে দুই হাজার আট শত মেগাওয়াটই আমেরিকাতে উৎপাদিত হচ্ছে। আইসল্যান্ড বিদু্যৎ উৎপাদন ও ঘর গরম করার কাজে ব্যবহূত শক্তির বেশির ভাগই সংগ্রহ করে ভূ-তাপীয় শক্তির উৎস থেকে। নিউজিল্যান্ড ও ইতালির মোট ব্যবহূত শক্তির ১১ শতাংশ এবং ৩ শতাংশ সংগ্রহ করে ভূ-তাপীয় শক্তি থেকে। এটি পরিবেশবান্ধব এবং দিনরাত সবসময়ই এ থেকে শক্তি সরবরাহ পাওয়া সম্ভব। তবে, এ পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পূর্বে বিশাল অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়।
বৈদ্যুতিক গাড়ি থেকে কোনো ধরনের ধোঁয়া বের হয় না। এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচও খুবই কম। তবে, ব্যাপকভাবে প্রচলনের জন্য এটিকে প্রযুক্তিগত দিক থেকে আরও উন্নত করার কথা ভাবছে বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলো।
হাইড্রোজেন ফুয়েল সেলে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় উৎপাদিত হয়। এর সাহায্যে চলে একটি বৈদ্যুতিক মোটর। এ ধরনের ইঞ্জিন থেকে জল নির্গত হয়। তবে, এ প্রযুক্তির কিছু সমস্যা রয়েছে। বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যাবহার করতে হয়, ফলে এতে কার্বন উৎপাদনের কিছু সম্ভাবনা থেকেই যায়।
সৌর কিরণের প্রভাবে সমুদ্রের উপরিভাগ ও নিম্নভাগের জলর তাপমাত্রার পার্থক্য থেকে বিশেষ প্রযুক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করা সম্ভব। সমুদ্রের জলর তাপীয় অসমতা থেকে বিদু্যৎ উৎপাদন করার প্রযুক্তিকে সমুদ্রের তাপীয় শক্তির পরিবর্তন প্রযুক্তি বা ওটেক বলা হয়। এই শক্তিকে পুরোপুরি বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তর করতে পারলে তা হবে আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহূত বিদু্যতের চেয়ে বিশগুণ বেশি।
যেভাবে দিনের পর দিন বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে, তাতে জীবাশ্মজ্বালানি থেকে লাগামহীনভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতে থাকলে আগামী দিনে বিশ্বের জ্বীবাশ্ম জ্বালানির সঞ্চয় অবশ্যই ফুরিয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিকল্প উৎসগুলোর উপর নির্ভরশীলতা ক্রমশই বাড়তে থাকবে। বিকল্প শক্তির উৎসগুলো ব্যবহারে কিছু জটিলতা ও সমস্যা থাকলেও এসব শক্তির উৎসই আগামীদিনের প্রধান শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হবে। আর মানুষকে এখনি তার প্রস্তুতি নিতে হবে।
সূত্র: বিকাশপিডিয়া টীম
সর্বশেষ সংশোধন করা : 7/11/2020