হুগলির শিয়াখালার শেখ মহবুব অবশ্য পইপই করে বারণ করেছিলেন স্ত্রী নাফিসাকে। তাঁর থেকে প্রায় বছর দশেকের ছোট নাফিসা। মহবুব যখন অসুস্থ হলেন, নাফিসার কোলে সদ্যোজাত সন্তান। অনেকেই বলেছিলেন, কিডনি দিতে গিয়ে কোনও গোলমাল হলে নাফিসাও মারা যেতে পারেন। তখন বাচ্চাটার কী হবে? কিছুই অবশ্য নাফিসা বিবিকে টলাতে পারেনি। একগাল হেসে বলেন, “বাপের বাড়ি থেকে কত্ত বারণ করল। কিন্তু আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম, ওকে বাঁচাতেই হবে। আমি কিডনি দেব, তার পর যা হবে আল্লা সামলাবে।” ২০০২ সালে দু’জনে একসঙ্গে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকেছেন। এসি ঘরের ঠান্ডায় নাফিসার শরীরে কাঁপুনি ধরছে আর তা দেখে মহবুব ভাবছেন, স্ত্রী বুঝি কিডনি দিতে ভয় পাচ্ছেন। বলেছিলেন, “এখনও বলো, আমি বারণ করে দিচ্ছি।” ধাতানি দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন নাফিসা।
৩৯ বছরের দাম্পত্যজীবন বিষ্ণুমায়া ও ইন্দ্রদুলাল মুখোপাধ্যায়ের। বাড়ি বেহালা পর্ণশ্রীতে। ২০০২ সালে বিষ্ণুমায়া নিজের একটি কিডনি দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন ইন্দ্রদুলালকে। সিদ্ধান্তটা স্ত্রীর ওপরেই ছেড়েছিলেন ইন্দ্রদুলাল। আর বিষ্ণুমায়া একটা কথা সাফ বুঝেছিলেন, ইন্দ্রদুলালকে ছাড়া তাঁর জীবনটা ঠিক ‘জীবন’ থাকবে না। ভয় দেখিয়েছিল অনেকে। কিন্তু মনস্থির করে ফেলার পর আর টলানো যায়নি বিষ্ণুমায়াকে। এমনকী অপারেশনের ঠিক আগের দিনও একটা বিয়েবাড়ি গিয়েছিলেন। নেফ্রোলজিস্ট শিবাজি বসু বলছিলেন, “আমার দীর্ঘ চিকিৎসক জীবনে দেখেছি, স্বামীর জন্য স্ত্রী বা স্ত্রীর জন্য স্বামী কিডনি দিলে পরবর্তী কালে তাঁদের শারীরিক অসুবিধে অনেক কম হয়। ভাল ভাবে বাঁচতে পারেন তাঁরা। কেন এমন হয় ব্যাখ্যা দিতে পারব না। হয়তো মানসিক ব্যাপারটাও এর সঙ্গে জড়িত।” চিকিৎসক অরূপরতন দত্তের মতে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কিডনি দেওয়া-নেওয়া হলে দালালচক্র আটকানো যায়। রোখা যায় বেআইনি লেনদেন। আর কিডনি জোগাড়ের ঝক্কি তো কমেই। হাতের কাছে দাতা পাওয়া যায় বলে ডায়ালিসিস দরকার হয় না। দ্রুত কিডনি প্রতিস্থাপন করে রোগীকে ‘কোয়ালিটি লাইফ’ দেওয়া যায়। তাঁর বক্তব্য, “এখন এমন পদ্ধতি এসেছে যাতে স্বামী-স্ত্রী-র রক্তের গ্রুপ না মিললেও বিশেষ পদ্ধতিতে রক্তের অ্যান্টিবডি বাদ দিয়ে সেই কিডনি নেওয়া যায়। ফলে স্বামী বা স্ত্রী এগিয়ে আসতে চাইলে পদ্ধতিগত ভাবে বিষয়টা এখন আরও সহজ।”
পাশের টেবিলে পাশাপাশি বসে অরূপরতনবাবুর কথা শুনছিলেন শ্রীদাম পাত্র ও প্রতিমা পাত্র। বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার কৃষ্ণনগর গ্রামে। ২০১০ সালে নিজের একটি কিডনি স্বামী শ্রীদামকে দিয়েছিলেন প্রতিমা। শুধু প্রেম থেকেই তাগিদটা এসেছিল, নাকি মিশে ছিল দায়িত্ব-কর্তব্য? ব্যাখ্যা নেই প্রতিমার কাছে। শুধু একমুখ হাসি নিয়ে বললেন, “মানুষটার বড্ড রাগ। এখনও রেগে গেলে ভয়ানক চিৎকার করে। ভাতের থালা, দুধের গ্লাস উল্টে দেয়। আমার তখন খারাপ লাগে। আবার পর ক্ষণে মনে হয়, দেহের ভিতর আমার কিডনিখানা রয়েছে বলেই না অমন তেজ দেখাতে পারছে। ব্যস, তখনই আমার সব অভিমান জল হয়ে যায়।”
সূত্র : পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 10/15/2019