ভালবাসতে চেয়ে, কাছে থাকতে চেয়ে, আঁকড়ে ধরতে চেয়ে দেওয়া উপহার! শুধু তোমার জন্য।
দ্যুতিময় হিরে, দামি বিদেশি চকোলেট, বহুমূল্য পোশাক, নাকি তার চেয়েও বেশি দামি কিছু? ও’ হেনরির বিখ্যাত গল্পে যেমন নিজের মেঘের মতো চুল বিক্রি করে স্বামীর প্রিয় ঘড়ির জন্য চেন কিনে আনেন নায়িকা। তত ক্ষণে অবশ্য স্ত্রীর চুলের জন্য চিরুনি কিনতে ঘড়িটি বিক্রি করেছেন নায়ক। কিন্তু ‘দ্য গিফট অব দ্য ম্যাজাই’-এর সেই অমর কাহিনিকেও যেন ম্লান করে দেয় আমাদের চার পাশের আপাত ছাপোষা কিছু দাম্পত্য জীবনের উপহার।
কিছু আশ্চর্য মানুষ। যাঁরা ভালবাসার মানুষটিকে হৃদয় তো আগেই দিয়েছিলেন, এ বার তাঁর জন্য নিজের শরীর থেকে একতাল মাংস কেটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেও মুহূর্ত সময় নেন না। ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’-র ঠিক দু’দিন আগে ফর্টিস হাসপাতালের সাততলার হলঘরে দেখা হয়েছিল এই রকম কিছু দম্পতির সঙ্গে। ভবিতব্যকে চ্যালেঞ্জ করে নিজেদের জীবন বাজি রেখে যাঁরা মৃত্যুর মুখ থেকে কেড়ে এনেছেন সঙ্গীকে। তাঁকে বাঁচিয়ে তুলেছেন নিজের একটি কিডনি দিয়ে।
আর এখানেই জিতে গিয়েছে এক আকাশ ভর্তি প্রেম। গুঁড়িয়ে গিয়েছে সময়ের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসা ফিকে হয়ে যাওয়ার তত্ত্ব।
চোদ্দো বছর আগের এক পৌষমাসে সদ্য আঠারোয় পা দেওয়া রুমা-কে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে বিয়ে করেছিলেন হাওড়া রামরাজাতলার দেবেন্দ্র। তিনি নিজেও তখন মেরেকেটে ২৩-২৪। আর্থিক সংস্থান ছিল না, কিন্তু ভালবাসায় আস্থা ছিল জবরদস্ত। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বজ্রপাত। হাসপাতালের হলঘরের টেবিলে বসে রুমার হাতটা ধরে সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে এখনও চোখ জলে ভরে যাচ্ছিল দেবেন্দ্রর। “ডাক্তারবাবু বললেন, ওর দু’টো কিডনিই নষ্ট। মরে যেতে পারে। ৪ বছর ধরে ডায়ালিসিস হল। ওর যা কষ্ট হতো, সহ্য করতে পারতাম না। ওর হাতে সুচ ফোটাত আর আমি বাথরুমে গিয়ে কাঁদতাম। তার পর এক দিন ঠিক করলাম, অনেক হয়েছে। রুমার হাত যখন এক বার ধরেছি তখন এই হাত কেউ কেটে না-দেওয়া পর্যন্ত ছাড়ব না। শেষ দেখব। ডাক্তারবাবুকে বললাম, ব্লাডগ্রুপ যখন মিলছে তখন আমি কিডনি দেব।” ঝড় বয়ে গিয়েছিল পরিবারে। বেশির ভাগ আত্মীয়স্বজন বারণ করেছিলেন, ভয় দেখিয়েছিলেন। আবার বিয়ে করার পরামর্শ পর্যন্ত এসেছিল ‘যে মরছে সে মরছে, তার সঙ্গে যেচে মরার কী দরকার?’ কিন্তু সব আপত্তি উড়ে গিয়েছিল দেবেন্দ্রর একরোখাপনায়। ২০০৬-এ নিজের একটি কিডনি দিয়ে স্ত্রীকে বাঁচান দেবেন্দ্র। গল্প শোনাচ্ছিলেন অপারেশনের পরে যখন হুঁশ এল, তখন ডাক্তারেরা ব্যথা কমানোর ওষুধ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি জানিয়েছিলেন, এত দিন বুকে যে মারাত্মক পাথরচাপা যন্ত্রণা ছিল সেটা যখন চলে গিয়েছে, তখন আর পেটের ব্যথার জন্য ওষুধ লাগবে না। শুনে লাজুক হেসে মুখ নামিয়েছেন রুমা। বলেছেন, “আমি শুধু ওকে বলেছিলাম ‘আমাকে বাঁচা। মরতে দিস না। আমি তোর সঙ্গে অনেক দিন বাঁচতে চাই।’ ও সেটা করেছে।”
সূত্র : পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/16/2020