ক্যানসার রোগীরাও নিশ্চয়ই মা হতে পারেন। ক্যানসারের চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর মা হওয়া অবশ্যই সম্ভব।
শহুরে মেয়েদের মধ্যে ব্রেস্ট এবং গ্রামীণ মেয়েদের ক্ষেত্রে সারভাইক্যাল ক্যানসারই মূলত দেখা যাচ্ছে। এছাড়া মুখের ক্যানসার, রেকটাম, লাং এবং কোলন ক্যানসারও হতে দেখা যায়।
প্রজননক্ষেত্রের ব্যাপারটা শরীরের কোন অঙ্গে ক্যানসার হয়েছে এবং কোন ধরনের চিকিৎসার দরকার তার ওপরে এটা নির্ভর করে।
যেমন—ক্যানসারের চিকিৎসা মূলত তিনভাবে করা হয় সার্জারি, রেডিওথেরাপি এবং কেমোথেরাপি। সার্জারির ক্ষেত্রে একজন রোগীর শুধু যে অপারেশন হয় তা নয়, রেডিওথেরাপি বা কেমোথিরাপিও হতে পারে। যদিও এই তিনটি চিকিৎসাই প্রজননের জন্য কোনও না কোনওভাবে সম্পর্কযুক্ত।
সার্জারি যদি ইউটেরাস এবং ওভারি, অন্যান্য প্রজনন অঙ্গে হয় তা হলে সমস্যা, না হলে সার্জারির সঙ্গে সন্তানধারণ সরাসরি যুক্ত নয়। অপারেশন করে ফিমেল অর্গান বাদ দেওয়া হলে সন্তানধারণ সম্ভব নয়, কিন্তু যদি শরীরের অন্য অঙ্গে বা অংশে ক্যানসার হয়, তার সঙ্গে সন্তানধারণের কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁরা চিকিৎসকের পরামর্শানুসারে সেই ব্যাপারে এগতে পারেন একজন স্বাভাবিক নারীর মতোই।
রেডিয়েশন অর্থাৎ রশ্মি দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। তখন যদি মহিলাদের প্রজনন অঙ্গে রেডিয়েশনের প্রয়োজন পড়ে তখন সমস্যা হতে পারে। যদি ব্রেস্ট, কোলন, রেক্টাম, লাং বা অন্য অংশে ক্যানসার চিকিৎসায় রেডিয়েশন দিতে হয় তাহলে সন্তানধারণে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কারণ এটা লোকাল ট্রিটমেন্ট।
প্রজনন অঙ্গে রেডিয়েশন দিতে হলে সেখানে কিছু পরিবর্তন আসে। যার ফলে প্রজননের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হতে পারে। ওভারিতে রেডিয়েশন দিতে হলে সাময়িকভাবে প্রজনন শক্তি কমে যায়। আবার ভবিষ্যতে সেটা ফেরার সম্ভাবনা থাকলেও সেটা রোগীর ক্ষেত্রে ঘটনা অনুযায়ী নির্ভর করে।
রেডিয়েশন লোকাল এরিয়ায় দেওয়া হলেও কেমোথেরাপির ক্ষেত্রে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে রক্তের মধ্যে ওষুধ দেওয়া হয় যা সারা শরীরেই প্রবাহিত হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ওষুধগুলি ওভারি বা প্রজনন অঙ্গের ক্ষতি খুব বেশি করে।
রেডিয়েশন এবং কেমোথেরাপি দুটির ক্ষেত্রেই আর একটা সমস্যা হয়, যেটা হল লস অব লিবিডো—অর্থাৎ স্বাভাবিক যৌন ইচ্ছে কমে যায়। কেমোতেও রেডিয়েশনের মতো লস অব লিবিডো, ওভাম সিক্রিয়েশন কমে, ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস হয়। ইয়ং কাপলের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় সমস্যা, যা সন্তানধারণের সঙ্গেও জড়িয়ে। রেডিয়েশন দিলে নারীদের ক্ষেত্রে ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস হয়। সেক্ষেত্রে সাময়িক অসুবিধা কাটাতে লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে আশার কথা এগুলো সময়ের ব্যাপার। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সমস্যা হলেও এক্ষেত্রে যত সময় যেতে থাকে, ৬ মাস, ১ বছর চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর সাময়িক এইসব সমস্যা কমতে থাকে। ওভারিয়ান ফাংশান ফিরে আসে। ক্রমশ চিকিৎসার শেষের দিকে উন্নতি লক্ষ করা যায়।
ক্যানসার রোগী মা হতে চাইলে আমরা চিকিৎসা চলাকালীন কনসিভ করার ব্যাপারে না বলব। তবে ট্রিটমেন্ট শেষ হওয়ার পর ছ মাস বা ১, ২ বছরের একটা গ্যাপ দিয়ে স্বাভাবিকের কাছাকাছি অবস্থায় পৌঁছে ডিসিশন নেওয়াই যায়—সেক্ষেত্রে সাধারণত কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে সেটা একজন প্রজননবিদের পরামর্শেই করতে হবে। ফিমেল অর্গান রিলেটেড ক্যানসার না হলে ক্যানসারের চিকিৎসায় গর্ভধারণে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
অনেক সময়ে ক্যানসারের রোগী বা তাঁর পরিবার চিকিৎসা এবং সন্তানধারণ নিয়ে নানা ভ্রান্ত ধারণায় থাকেন।
সত্যিই তাই। কোনও ক্ষেত্রে রোগীর সব ধরনের চিকিৎসাই দরকার পড়ে। সার্জারি ছাড়াও রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি বা হরমোনাল থেরাপি করতে হয়। সেটা রোগীর প্রয়োজন বুঝে চিকিৎসক নির্ধারণ করবেন, কোনটা করা দরকার। রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি হলে আর সন্তান হবে না বা শারীরিক সম্পর্ক উচিত নয়— এমন বিভিন্ন ভ্রান্ত ধারণায় পড়ে আরও ক্ষতি বেশি হয়। চিকিৎসা চলাকালীন কিছু সমস্যা হতে পারে। সমাধানের জন্য চিকিৎসক আছেন, তাঁর ওপর ভরসা রাখুন।
ইয়ং কাপলের ইস্যু না থাকলে আগে আলোচনা করে নিই। কমবয়সি মেয়ের ফিমেল অর্গান রিলেটেড ক্যানসার হলে আমরা তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সন্তান কবে চান, কটি সন্তান আছে সব জেনে নিয়ে চিকিৎসার ধরন নিয়েও আলোচনা করি, তাঁদের একটু সময় নিয়ে (এক সপ্তাহ) ভেবে জানাতে অনুরোধ করি। ফিমেল অর্গানে সার্জারি করতে হলে আগে ওভাম সংরক্ষণের কথা বলি এবং প্রজননবিদের কাছে আমরাই পাঠাই। সেই মতামতটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ক্যানসার রোগীর বেঁচে থাকাটা যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ভালো থাকাটাও সমান জরুরি।
ফিমেল অর্গানে ক্যানসারে বয়সটা গুরুত্বপূর্ণ হলেও রোগী হিসাবে আমাদের কাছে সবাই সমান। একজন কমবয়সি এবং ৩৫/৪৫ বছরের মহিলাকে একই পরামর্শ দিই, কারণ বয়সের সঙ্গে চাহিদাটা তো আর শেষ হয়ে যায় না। কমবয়সি মেয়ের ক্যানসার হলে সন্তান ধারণ- জন্ম দেওয়াটা জড়িয়ে থাকে, এই সমস্যাটা একজন বয়স্কার ক্ষেত্রে না থাকলেও ভালোবাসার চাহিদাটা অস্বীকার করা যায় না। বয়স হয়ে গেছে বলেই তাঁর সব শেষ, আর কমবয়সি হলে সেটা বাঁচানোর চেষ্টা করা হবে—চিকিৎসক হিসাবে আমরা এভাবে ভাবি না। বরং উভয়ক্ষেত্রেই সুস্থ করাটাই আমাদের লক্ষ্য। ক্যানসার হওয়া মানেই জীবনের একটা দিক শেষ হয়ে যাওয়া নয়, সঠিক চিকিৎসা আর প্ল্যানিং দরকার।
না। আগেই বলেছি ট্রিটমেন্ট শেষ হওয়ার পর ছ মাস বা ১/২ বছরের একটা গ্যাপ দিয়ে স্বাভাবিকের কাছাকাছি অবস্থায় পৌঁছে ডিসিশন নেওয়াই যায়—সেক্ষেত্রে সাধারণত কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে সবার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এক নয় না, তাই ফলাফলও এক হয় না, কিছু পরিবর্তন থাকেই। তবে যাইহোক, সেটা একজন প্রজননবিদের পরামর্শেই করতে হবে।
সমস্যাগুলো নারীকেন্দ্রিক হলেও পুরুষের ভূমিকা অনেক। এইসময় স্ত্রী-এর পাশে থাকা, তাঁকে বোঝা এবং বোঝানো, সহমর্মিতাবোধ থাকা দরকার। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যের ভালোবাসাটাই পারে এইসব সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটাতে। তাই চিকিৎসার পাশাপাশি খুব কাজ দেয় দম্পতির নিজেদের ভালোবাসা। দরকার পড়লে কাউন্সেলিং করতে হবে। না হলে দেখেছি মানুষ অন্ধকারে হাতড়ান, এমনকী বিষয়টি সম্পর্কে যাঁরা যুক্তই নন এমন মানুষের পরামর্শ শুনেও অনেকের ক্ষতি হয়, মানসিক চাপ তৈরি হয়। বরং চিকিৎসকের কথামতো চলতে হবে।
মেয়েদের সংকোচও অনেক সময়ে তাঁদের পিছিয়ে দেয়, অবসাদে ভোগেন। তাঁদের বলব সংকোচ ভেঙে বেরিয়ে আসুন, সঠিক চিকিৎসার সাহায্য নিন। লড়াইটা চালিয়ে যান, দেখবেন ভবিষ্যৎটা অনেক সুন্দর হয়ে উঠবে।
তথ্য সংকলন: বর্তমান
সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/14/2020