- দিনে তিন বা তার বেশি বার পাতলা পায়খানা হলে শিশুর ডায়রিয়া হয়েছে৷ যত বেশিবার পাতলা পায়খানা হবে, ডায়রিয়া ততই বেশি বিপজ্জনক৷
- অনেকে মনে করেন তরল খেলে ডায়রিয়া বাড়ে৷ এ কথা ঠিক নয়৷ ডায়রিয়া বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুকে যত বার সম্ভব তরল খাওয়াতে হবে৷ প্রচুর তরল গ্রহণ করলে ডায়রিয়ার দরুণ শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া তরল ফিরে পেতে সাহায্য হয়৷
ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুর জন্য উপযোগী পানীয়:
- বুকের দুধ (মায়েরা সাধারণতঃ যা দেন তার থেকে থেকে বেশি ঘন ঘন স্তন্যপান করাবেন)
- সুপ বা সুরুয়া
- ভাতের ফ্যান
- টাটকা ফলের রস
- অল্প চিনি দিয়ে হালকা চা
- ডাবের জল
- নিরাপদ উত্স থেকে পরিষ্কার জল৷ যদি জল অপরিষ্কার হবার সম্ভাবনা থাকে তাহলে ফুটিয়ে বা ফিল্টার করে বিশুদ্ধ করে নিতে হবে৷
- উপযুক্ত পরিমাণ পরিষ্কার জলের সঙ্গে মিশ্রিত ওরাল রিহাইড্রেশন সল্টস (ওআরএস) ৷ (মুখ্য বক্তব্য 5 এর পরবর্তী বক্স দেখুন)
জলশূন্যতা এড়াতে, বুকের দুধ খাওয়া শিশুদের যতবার সম্ভব স্তন্যপান করাতে হবে, এবং অন্য শিশুরা প্রতিবার পাতলা পায়খানার পরে নিম্নলিখিত পরিমাণ তরল খাবে:
- দু বছরের কম বয়সী শিশুর জন্য: একটি বড় কাপের সিকি থেকে অর্ধেকটা
- দু বছর বা তার বেশি বয়সের শিশুর জন্য: একটি বড় কাপের অর্ধেকটা থেকে পুরোটা৷
পানীয় পরিষ্কার কাপ থেকে দিতে হবে৷ ফীডিং বোতল কখনোই ব্যবহার করা উচিত নয়৷ বোতল পুরোপুরি পরিষ্কার করা কঠিন এবং অপরিষ্কার বোতল থেকে ডায়রিয়া হতে পারে৷
শিশুটি বমি করলে, পরিচর্যাকারী 10 মিনিট অপেক্ষা করে আবার শিশুটিকে ধীরে ধীরে ছোটো ছোটো চুমুকে পানীয়টি খাওয়াতে শুরু করবেন৷
ডায়রিয়া না থামা পর্যন্ত শিশুটিকে অতিরিক্ত তরল দিতে হবে৷
ডায়রিয়া সাধারণতঃ তিন বা চার দিনে বন্ধ হয়ে যায়৷ এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এটি চলতে থাকলে পরিচর্যাকারীদের প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে সাহায্য চাওয়া উচিত৷
মুখ্য বক্তব্য 2: এক ঘণ্টার মধ্যে একাধিক বার পাতলা পায়খানা হলে বা মলে রক্ত এলে শিশুর জীবনের আশঙ্কা থাকে৷ এই অবস্থায় প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্য কর্মীর কাছ থেকে অবিলম্বে সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন৷
বাবা-মায়েদের অবিলম্বে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে সাহায্য চাওয়া উচিত যদি শিশুর:
- এক দুই ঘণ্টার মধ্যে একাধিক বার পাতলা পায়খানা হয়
- মলের সঙ্গে রক্ত থাকে
- ঘন ঘন বমি করে
- জ্বর থাকে
- অত্যন্ত পিপাসার্ত বোধ করে
- জল খেতে না চায়
- খেতে না চায়
- চোখ বসে যায়
- দুর্বল দেখায় বা অবসন্ন হয়ে পড়ে
- এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ডায়রিয়ায় ভুগতে থাকে৷
শিশুর যদি এর মধ্যে কোনো লক্ষণ থাকে, প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর সাহায্য জরুরি৷ এর মধ্যে শিশুটিকে ওআরএস দ্রবণ বা অন্যান্য তরল খাইয়ে যেতে হবে৷
শিশু যদি এক দুই ঘণ্টার মধ্যে একাধিক বার পাতলা পায়খানা করে এবং বমি করে তাহলে আশঙ্কার কারণ আছে— এগুলি কলেরার সম্ভাব্য লক্ষণ৷ কলেরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শিশুদের মৃত্যু ঘটাতে পারে৷ অবিলম্বে চিকিত্সকের সাহায্য নিন৷
- সংক্রামিত জল বা খাদ্যের মাধ্যমে কলেরা সম্পূর্ণ সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ খারাপ স্বাস্থ্যবিধি ও অত্যধিক ঘন লোকবসতি যুক্ত পরিস্থিতিতেই সাধারণতঃ কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়৷
- কলেরা বা ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়া আটকানোর চারটি ধাপ আছে:
- সব মল পায়খানা বা শৌচাগারে ফেলুন বা পুঁতে ফেলুন
- মল স্পর্শের পরে হাত ভালোভাবে সাবান বা ছাই ও জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন
- নিরাপদ পানীয় জল ব্যবহার করুন
- সব খাবার ধুয়ে, খোসা ছাড়িয়ে বা রান্না করে খান৷
মুখ্য বক্তব্য 3: বুকের দুধ খাওয়ালে ডায়রিয়ার তীব্রতা ও বার বার হবার সম্ভাবনা কম হয়৷
- ডায়রিয়া আক্রান্ত ছোটো বাচ্চার জন্য বুকের দুধ খাদ্য ও পানীয়ের সবথেকে ভালো উত্স৷ এটি পুষ্টিকর ও পরিষ্কার এবং অসুস্থতা ও সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে৷ কেবলমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানো হয় এমন বাচ্চার ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম৷
- বুকের দুধ জলশূন্যতা ও অপুষ্টি রোধ করে এবং শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া তরল ফিরে পেতে সাহায্য করে৷ মায়েদের অনেক সময় শিশুর ডায়রিয়া হলে কম বুকের দুধ দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়৷ এই পরামর্শটি ভুল৷
- শিশুর ডায়রিয়া হলে মায়েরা সাধারণতঃ যা দেন তার থেকে থেকে বেশি ঘন ঘন স্তন্যপান করাবেন৷
মুখ্য বক্তব্য 4: ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুর নিয়মিত খাদ্যগ্রহণ চালিয়ে যাওয়া দরকার৷ ডায়রিয়া থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার সময়, অন্ততঃ দু সপ্তাহ পর্যন্ত শিশুটির দৈনিক অন্ততঃ একটি বাড়তি ভোজনের দরকার৷
- ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুর ওজন কমে যায় ও দ্রুত অপুষ্টিতে ভুগতে পারে৷ ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুর যতটা সম্ভব খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করতে হবে৷ খাদ্য ডায়রিয়া থামাতে ও শিশুকে আরো দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করে৷
- ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশু খেতে না চাইতে পারে বা বমি করতে পারে, কাজেই খাওয়ানো মুশকিল হতে পারে৷ শিশুর বয়স ছ মাস বা তার বেশি হলে বাবা-মা ও পরিচর্যাকারীদের অল্প অল্প পরিমাণে নরম চটকানো খাবার বা শিশুটির পছন্দের খাবার দিয়ে শিশুটিকে যত ঘন ঘন সম্ভব খেতে উত্সাহিত করতে হবে৷ এই সব খাবারে স্বল্প পরিমাণ নুন থাকতে হবে৷ নরম খাবার খাওয়া সহজ ও তাতে শক্ত খাবারের থেকে বেশি তরল থাকে৷
- ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুকে যে সব খাবার দিতে পরামর্শ দেওয়া হয় তা হল ভালো করে চটকানো দানা শস্য ও শিম জাতীয় শস্যের মিশ্রণ, মাছ, সুসিদ্ধ মাংস, দই ও ফল৷ দানাশস্য ও সবজিতে এক বা দুই চা-চামচ তেল দেওয়া যেতে পারে৷ খাবার টাটকা বানানো হতে হবে এবং শিশুকে দিনে পাঁচ থেকে ছ বার দিতে হবে৷
- ডায়রিয়া বন্ধ হবার পর, পুরো সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য বাড়তি খাবার খাওয়ানো অত্যাবশ্যক৷ এই সময়ে, অন্ততঃ দু সপ্তাহ পর্যন্ত শিশুটির দৈনিক একটি বাড়তি ভোজনের দরকার, বা বেশি স্তন্যপানের দরকার৷ এর ফলে শিশুটি ডায়রিয়ার দরুণ হারানো শক্তি ও পুষ্টি ফিরে পেতে সাহায্য হবে৷
- অসুস্থতা আরম্ভ হবার আগে শিশুর যা ওজন ছিল অন্ততঃ সেই ওজন ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত শিশুটিকে ডায়রিয়া থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ বলা যাবে না৷
- ভিটামিন এ ক্যাপসুল ও ভিটামিন এ সংবলিত খাবার শিশুকে ডায়রিয়া থেকে সেরে উঠতে সাহায্য করে৷ যে সব খাবারে ভিটামিন এ পাওয়া যায় তার মধ্যে আছে বুকের দুধ, মেটে, দুধ ও দুগ্ধজাত বস্তু, কমলা বা হলুদ রঙের ফল, এবং সবুজ পাতাওয়ালা শাকসবজি৷
মুখ্য বক্তব্য 5: শিশুটি যদি তীব্র বা অবিরাম ডায়রিয়ার কারণে জলশূন্য হয়ে পড়ে, তাহলে কেবলমাত্র প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্য কর্মীর সুপারিশ করা ওরাল রিহাইড্রেশন দ্রবণ বা ওষুধ দিতে হবে৷ অন্য ডায়রিয়ার ওষুধ সাধারণতঃ কাজ করে না এবং শিশুর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে৷
- ডায়রিয়া কয়েক দিনের মধ্যে নিজে থেকেই সেরে যায়৷ প্রকৃত বিপদ হচ্ছে শিশুটির শরীর থেকে তরল ও ও পোষকের হানি, যার ফলে জলশূন্যতা ও অপুষ্টি দেখা দিতে পারে৷
- ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুকে কোনো প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর অনুমোদন ছাড়া কখনো কোনো বড়ি, অ্যাণ্টিবায়োটিক বা অন্য ওষুধ দেবেন না৷
- ডায়রিয়ার সবথেকে ভালো চিকিত্সা হল প্রচুর জল ও তরল এবং জলে ঠিকমত ভাবে গোলা ওরাল রিহাইড্রেশন সল্টস (ওআরএস) পান করা৷
- ওআরএস প্যাকেট না পাওয়া গেলে, জলশূন্যতার চিকিত্সা করার জন্য সমান সমান করে নেওয়া চার চা-চামচ চিনি এবং সমান করে নেওয়া অর্ধেক চা-চামচ নুন এক লিটার পরিষ্কার জলে গুলে একটি পানীয় প্রস্তুত করে শিশুটিকে খাওয়ানো যেতে পারে৷ সঠিক পরিমাণ মেশানোর বিষয়ে খুব সতর্ক থাকবেন কারণ বেশি চিনি ডায়রিয়া বাড়িয়ে দিতে পারে, এবং বেশি নুন শিশুটির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক হতে পারে৷ মিশ্রণটি একটু বেশি পাতলা করে বানালে কোনো ক্ষতি হবে না এবং তার কার্যকারিতাও এমন কিছু কম হবে না৷
- হাম থেকে প্রায়ই তীব্র ডায়রিয়া হয়৷ শিশুদের হামের টিকা দিলে এই ধরনের ডায়রিয়া প্রতিরোধ করা যায়৷
মুখ্য বক্তব্য 6: ডায়রিয়া আটকাতে সব মল পায়খানা বা শৌচাগারে ফেলতে হবে বা পুঁতে ফেলতে হবে৷
- শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্করা ডায়রিয়ার জীবাণু গিলে ফেলতে পারে যদি বাড়ির পানীয় জল, খাবার, হাত, বাসন বা খাবার তৈরির জায়গায মলের স্পর্শ লাগে৷ প্রথমে মলে ও তারপরে খাবারে বসা মাছিরা ডায়রিয়ার জীবাণু সংক্রামিত করে৷ খাবার ও পানীয় জল ঢাকা দিয়ে রাখলে মাছির হাত থেকে বাঁচানো যায়৷
- সব মলে, এমন কি একেবারে শিশু ও ছোটো বাচ্চাদের মলেও, জীবাণু থাকে ও সেই জন্য তা বিপজ্জনক৷ শিশুরা পায়খানা বা শৌচাগারে মলত্যাগ না করলে, তাদের মল সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে এবং শৌচাগারে ফেলতে হবে বা পুঁতে ফেলতে হবে৷ পায়খানাs ও শৌচাগার পরিষ্কার রাখলে জীবাণু. ছড়িয়ে পড়া আটকানো যায়৷
- যদি শৌচাগার বা পায়খানা না থাকে, প্রাপ্তবয়স্করা এবং শিশুরা ঘরবাড়ি, রাস্তা, জল সরবরাহ ব্যবস্থা ও শিশুদের খেলার জায়গা থেকে দূরে মলত্যাগ করবে এবং তারপরে মল এক স্তর মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে৷
- যে সব জনসম্প্রদায়ের কাছে শৌচাগার বা পায়খানা নেই, তাঁরা সেগুলি নির্মাণের জন্য একজোট হবার কথা বিবেচনা করতে পারেন৷ জলের উত্স পশু বা মানুষের মল থেকে দূরে হওয়া উচিত৷
মুখ্য বক্তব্য 7: ভালো স্বাস্থ্য অভ্যাস ডায়রিয়ার হাত থেকে বাঁচায়৷
মলের স্পর্শের পরে এবং খাবার স্পর্শ করার আগে বা শিশুদের খাওয়ানোর আগে হাত ভালোভাবে সাবান ও জল বা ছাই ও জল দিয়ে ধুতে হবে৷
- মলত্যাগ করার পরে, শিশুর পশ্চাদ্দেশ পরিষ্কার করার পরে, এবং শিশুদের খাওয়ানোর আগে, খাবার স্পর্শ করার আগে বা খাবার আগে সবসময় হাত সাবান ও জল অথবা ছাই ও জল দিয়ে ধুতে হবে৷
- ছোটো শিশুরা প্রায়ই মুখে হাত দেয়, কাজেই ঘরদোর পরিষ্কার রাখতে হবে ও শিশুদের হাত প্রায়ই জল ও সাবান বা ছাই দিয়ে ধোয়াতে হবে, বিশেষ করে তাদের খাবার দেবার আগে ৷
অন্য স্বাস্থ্যবিধি যা ডায়রিয়া রোধ করতে সাহায্য করে:
- খাবার ঠিক খাদ্যগ্রহণের আগেই তৈরী ও ভালোভাবে রান্না করা উচিত৷ খাবার রেখে দিলে তাতে জীবাণু জমতে পারে যা থেকে ডায়রিয়া হওয়া সম্ভব৷ খুব গরম বা খুব ঠাণ্ডা না রাখলে দু ঘণ্টা পরে রান্না করা খাবার আর নিরাপদ থাকে না৷
- মাছিরা যাতে রোগ ছড়াতে না পারে সেইজন্য সমস্ত জঞ্জাল পুঁতে, পুড়িয়ে বা নিরাপদ ভাবে ফেলে দিতে হবে৷
সুত্রঃ UNICEF