ডাঃ ধীমান গঙ্গোপাধ্যায়, চেস্ট বিশেষজ্ঞ
যখনই কেউ চিকিৎসকের কাছে শারীরিক সমস্যা নিয়ে হাজির হন, তখন প্রত্যাশা থাকে, ডাক্তারবাবু হয়তো বলবেন, ‘এই সিরাপটা দু’চামচ দু’বেলা খাবেন। এই ক্যাপসুলটা দিনে দু’টো করে পাঁচ দিন চলবে। আশা করি পরশু দিনের মধ্যে আপনার জ্বরটা কমে যাবে এবং পাঁচ দিনের মাথায় আপনি অফিসের স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করতে পারবেন।’ অর্থাৎ রোগী শুধু নিরাময় আশা করছেন তা-ই নয়, তিনি চাইছেন চিকিৎসক তার নিরাময়ের দিনক্ষণও জানিয়ে দিন। এই প্রত্যাশা যে খুব একটা অযৌক্তিক তা নয়, কারণ বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান অত্যন্ত উন্নত এবং বিজ্ঞানের প্রাথমিক চরিত্রই হল সমস্ত প্রশ্নের নির্ভুল, নির্দিষ্ট উত্তর দিতে পারা। হ্যালির ধূমকেতু আবার কবে দেখা যাবে, পরের সূর্যগ্রহণ কবে হবে তার নির্দিষ্ট সময় আজই বলে দেওয়া সম্ভব। কাশি কবে সারবে সেটা চিকিৎসা বিজ্ঞান কেন নির্দিষ্ট করে বলতে পারবে না?
প্রখ্যাত ফরাসি বিজ্ঞানী লাপলা বলেছিলেন, “মহাবিশ্বের সমস্ত কণার গতিবেগ ও অবস্থান সঠিক ভাবে জানা থাকলে এবং গণনার যথেষ্ট ক্ষমতা থাকলে, ইতিহাসের পুরো গতিধারা নির্ধারণ করা সম্ভব হতো।”
আইনস্টাইনের বিখ্যাত উক্তি-- ঈশ্বর কখনও পাশা খেলেন না, অর্থাৎ এই বিশ্বজগত কার্যকারণ সর্ম্পকে বাঁধা। কারণ ছাড়া কার্য হয় না। চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রের জগত নিউটনের গতিসূত্রে বাঁধা। কাজেই যার অঙ্কটা জানা আছে তার পক্ষে নিঁখুত ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। এই তত্ত্বই লিনিয়ার ম্যাথম্যাটিকসের মূল বক্তব্য। তবে আমাদের এই জগৎসংসার নন-লিনিয়ার। অর্থাৎ অঙ্কের শুরুতে যদি সামান্য ভুল থাকে তবে শেষটায় বিরাট তফাত হয়ে যেতে পারে। যেমন ধরা যাক, আবহাওয়ার বিচার। এক বছর তো অনেক দূরের কথা, এক সপ্তাহের আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি বলা সম্ভব হয় না। নন-লিনিয়ার ম্যাথম্যাটিকস অনেকটা চলতি ইংরিজি প্রবাদবাক্যের মতো --- “ বাট ফর আ নেল দ্য শু ওয়াজ লস্ট, বাট ফর আ শু দ্য হর্স ওয়াজ লস্ট, বাট ফর হর্স দ্য রিং ওয়াজ লস্ট”।
চিকিৎসাবিজ্ঞান শুধু সম্ভাবনার কথা বলে। রোগ নির্ধারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে সময় সাপেক্ষ। অনেক অসুখই সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য নয়। নিরাময়যোগ্য হলেও কবে একেবারে সেরে যাবে তার সময় সারণি দেওয়া সম্ভব নয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই সীমাবদ্ধতা চিকিৎসকরা সামাজিক ভাবে আলোচনা করেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেদের চমকপ্রদ সাফল্যের প্রচারে থাকেন। এতে মানুষের প্রত্যাশা বাড়ে। শেষটায় চিকিৎসককেই এর মাশুল দিতে হয়। বিজ্ঞান হিসেবে চিকিৎসাশাস্ত্র পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র বা অঙ্কশাস্ত্রের মতো নয়। এই তথ্যটির প্রচার হওয়ার প্রয়োজন। তা না হলে সমাজের আকাশ ছোঁয়া প্রত্যাশা ক্রমশ অবস্থাটা জটিল করে তুলবে।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 10/15/2019