সুস্থতা কাকে বলা যাবে? কোনও উপসর্গ না-থাকাটাই কি সুস্থতা? কিন্তু কণামাত্র উপসর্গ নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। অল্পবিস্তর উপসর্গ সইবার, বইবার ব্যবস্থা আমাদের শরীরেই থাকে। তাই আমরা সচরাচর, মোটের উপর ভালো থাকি। এ সবই স্বাভাবিক। কিন্তু আধুনিক স্বাস্থ্য-কারবারিরা বলেন, এগুলো মোটেই স্বাভাবিক না। ছোটো-বড়ো যে কোনও উপসর্গই কোনও না কোনও ভয়ঙ্কর ব্যাধির পূর্বাহ্ন হতে পারে। এমনকী, উপসর্গ লুকিয়েও থাকতে পারে, আমরা হয়তো টের পাচ্ছি না। আমাদের তো শুধু মোটের উপর ভালো থাকলেই চলবে না, আরও বেশি বেশি ভালো থাকতে হবে। তাই আমাদের ব্যাধির পূর্বাহ্নগুলোকে আবিষ্কার করে ফেলতে হবে। তার জন্য শরীরের ব্যবস্থাপত্রগুলো ঠিকঠাক আছে কি না, চলছে কি না, তা মাঝে-মাঝে যাচাই করে দেখে রাখা দরকার। নইলে স্বাস্থ্য-গাড়ি আচমকা বিগড়ে যেতে পারে।
তাই সকাল-সন্ধে আমরা শুনতে পাই, কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপ, ভঙ্গুর অস্থি, শীর্ণতা আর পৃথুলতা নিয়ে আমরা নাকি এক অতি অসতর্ক জনসমষ্টি। ভয়ঙ্কর ঝুঁকি নিয়ে আমরা নাকি পাহাড়ের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছি। নীচেই আছে ক্যানসার, হৃদাঘাত, স্ট্রোক, ঊরুভঙ্গের মতো মরণ-খাদ। এখনই আমাদের সতর্ক হতে হবে, রোগের ঝুঁকিগুলোকে বাগে আনতে হবে। আর এ সব করতে হবে, উপসর্গ ফুটে ওঠার আগেই। কারণ, উপসর্গ ফুটে ওঠা মানে তো ‘অনেক দেরি’ হয়ে যাওয়া। দেরি করা একটা সেকেলে সংস্কার; আমাদের পূর্বপুরুষরা হয়তো অমন অলস ছিলেন। কিন্তু তাঁরা তো আধুনিক বিজ্ঞানের প্রসাদ পাননি। জীবন, মৃত্যু আর ব্যাধিকে তাঁরা যে ভাবে দেখেছিলেন এখন আর তা মেনে নেওয়া যায় না। জন্ম যদি পবিত্র হয় তা হলে মৃত্যুকেও পবিত্র হতে হবে, তাতে ব্যাধির কলুষ লাগলে চলবে না।
অতএব, ব্যাধিকে তার পূর্বাহ্নে ধরে ফেলে কুপোকাত করে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কুপোকাত করে দেওয়ার বিধি-বন্দোবস্ত আধুনিক চিকিত্সায় আছে, আর আধুনিক ডাক্তার হিসেবে আমরা তো বুদ্ধিমান বটেই। আধুনিক ডাক্তারি শাস্ত্র আমাদের জানিয়েছে যে জীবনের যাপন-পথে অনেক অদৃশ্য বেড়া থাকে। ওই বেড়াগুলো পেরোলেই স্বাস্থ্য আর বেগবান থাকবে না, শুরু হবে অস্বাস্থ্য। তাই বেড়াগুলোকে চিনে নিতে হবে; কোথায় কী ভাবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস আর ক্যানসারের মতো নিকৃষ্ট রোগগুলো ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে তা আগে-ভাগে জেনে ফেলতে হবে। এটাই তো যুক্তিশীলতা, একেই বলে বিজ্ঞানমনস্কতা। মানুষ তো উন্নত, যুক্তিশীল পশু ছাড়া অন্য কিছু না। তাই আমরা চেক-আপ ক্লিনিক বানিয়েছি, স্ক্রিনিং ক্লিনিক বানিয়েছি, --- সাধারণ, অসাধারণ, একজিকিউটিভ ইত্যাদি। যত গুড় ততই মিষ্টি।
এ সবই ভালো কথা, অন্তত ভালোই তো শোনায়। কিন্তু কতটা ভালো, কীসেই বা ভালো? উন্নত, আধুনিক ডাক্তারি নিয়ে আমাদের গর্ব করার যথেষ্ট কারণ আছে। উত্কৃষ্ট স্বাস্থ্য রচনার কাজটাও মন্দ কিছু না। কিন্তু একই সঙ্গে, আধুনিক ডাক্তারির আরও দরকারি কাজ ছিল। নিজের অপরিহার্যতার সঙ্গে সীমাবদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দেওয়াটাও তার দায়িত্ব ছিল। কোথায় থামতে হবে তা জানা আর জানানোটাও তার দায়িত্ব। জনমানুষকে এটাও জানানোর ছিল যে আমাদের জৈবিকতা একটা গাড়ি না; ডাক্তাররাও গাড়ির মেকানিক না। শরীর আর গাড়ির তুলনাটা নিরেট, নীরস ও ভ্রান্ত। জৈবিকতা নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করে নেয়, গাড়ি তা পারে না। আর তেমন কোনও গোলমাল হলে গাড়িটাকে তার সৃষ্টিকর্তার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু ডাক্তার তা পারেন না। অন্তত পারার কথা না। তাঁকে মনে রাখতে হয় যে উত্কৃষ্ট স্বাস্থ্য রচনার মহৎ চেষ্টায় তিনি যেখানে ব্যর্থ হবেন সেখান থেকে স্বাস্থ্য-বাজারের উত্থান হবে; তিনি যে-পরিমাণে ব্যর্থ হবেন ওই বাজার সেই পরিমাণে পরিপুষ্ট হবে।
সূত্র : এই সময়, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 11/14/2019