তাই ডাক্তারি শাস্ত্রকে শুধু কর্মব্যস্ত আর ক্রিয়াশীল হলে চলে না। কারণ, স্বাস্থ্য বলতে যে আসলে কী বোঝায় তা অস্পষ্ট। স্বাস্থ্যের কোনও জুত্সই সংজ্ঞাও হয় না। যেমন সৌন্দর্য, প্রেম, সুখানুভূতির কোনও সংজ্ঞা হয় না। স্বাস্থ্যের মর্ম বোঝা যায় ব্যাধির ছায়ায়; যেমন স্বাধীনতার মর্ম বোঝা যায় পরাধীন হলে, বন্দি হলেই। স্বাস্থ্যবান তাকেই বলে যে অসুস্থ হয় আর তা থেকে আবার মুক্ত হয়ে আসতে পারে; যদিও বিপন্ন সত্য এই যে আমরা মরণশীল। তাই বলে ডাক্তারিশাস্ত্র জনমানুষকে পরিতাপ করতে শেখায় না, অজানা ভয়ে সঙ্কুচিত থাকতে শেখায় না। অন্তত এগুলো তার কাজ না। তাই যে-শাস্ত্র মরণের ভয় দেখিয়ে ব্যাধিকাতর হতে শেখায়, ব্যাধির পূর্বাহ্নের নামে ব্যাধির মায়া রচনা করে, আর তার পর চিকিত্সার জয়গান করে সে আর যাই হোক ডাক্তারি না। তাকে বরং ‘মেডিকেলাইজেশন’ বলাই ভালো। জীবন-যাপনের বিচিত্র উপাদানগুলোকে, যে কোনও উপসর্গকে ডাক্তারি চিকিত্সার পরিসরে নিয়ে আসাটা মেডিকেলাইজেশন।
গড়পড়তা ডাক্তাররা এই কথাগুলো জানেন, বোঝেন। কিন্তু পারদর্শীরা তা মানতে চান না; যেন সাধারণ যুক্তিগুলো না-বোঝাটাই পারদর্শিতার শর্ত। তাই তাঁরা জনমানুষকে চেক-আপ আর স্ক্রিনিং-এর হদিস দেখান। তাঁদের মতে, হৃদাঘাত বা ক্যানসারের জন্য নাকি আমাদের বোকামিই দায়ী। নইলে বার্ধক্যে পৌঁছনোর আগে এ সব হবে কেন? উল্টো দিকে, বোকাসোকা মানুষজন কিন্তু জানেন যে বয়স মাপবার একটা ঘড়ি আমাদের হাতে থাকে ঠিকই, তবে তার সঙ্গে জৈবিকতারও একটা ঘড়ি থাকে। দু’টো ঘড়ির মধ্যে সম্পর্ক যেমন থাকে, বেদম তফাতও থাকে। সব চেয়ে বড়ো তফাত হল তাদের গতির হারে। তাই চল্লিশ বছর বয়সে যেমন স্ট্রোক হতে পারে, তেমনই বিরাশি বছরে গলফ খেলা যায়। তাই জনমানুষের বোকামির দিক থেকে নজর সরিয়ে পারদর্শীরা নজরটা নিজেদের দিকে রাখলে আরও ভালো হয়।
ভালো হয় জনমানুষের, কেননা ভয়-ভক্তি, কৌতূহল আর উদ্বেগ নিয়ে তাঁরা তো চেক-আপ ক্লিনিকগুলোতে ঢোকেন। ঢোকেন সুস্থ মানুষ হিসেবে আর বেরিয়ে আসেন রোগী হয়ে। তা হলে গড়পড়তা ডাক্তাররা এখন কী করবেন? তাঁরাই তো সাধারণের ভরসা। তাঁরা কি জনমানুষকে জানাবেন যে, সুস্বাস্থ্যের কোনও পূত-পবিত্র মানদণ্ড হয় না। মানদণ্ড বলে যা ধরা হয় তাতে বিজ্ঞানের যুক্তির চেয়ে বাজারের প্রভাব অনেক বেশি। তাই ওগুলোকে অঙ্কের ছকে ফেলে ডাক্তারিও হয় না। রোগ হওয়ার আগেই সারাও, এ কথা সংক্রামক রোগের বেলায় অনেক সময় সত্যি হতে পারে। কিন্তু ক্যানসারের মতো দীর্ঘকালীন ব্যাধির বেলায় তা এক বিশুদ্ধ ভণ্ডামি। বরং উপসর্গ দেখলে যথাশীঘ্র ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াই ঠিক। কোনও কোনও দেশে ডাক্তারদের সংগঠনগুলো তো সেই উপদেশই দিয়ে থাকে। তাতে অবান্তর উদ্বেগ থেকে মানুষ মুক্ত থাকেন। আমাদের কি সে-দায় নেই? থাকলে, আমাদের সস্নেহ প্রশ্রয়ের ছায়ায় বাড়বাড়ন্ত হল কাদের? তিরিশ-চল্লিশ বছর আগেও বাজার-সেবাকে ডাক্তারিতে গর্হিত কাজ বলেই ভাবা হত। এখন তা না। এখন বলা হয় এটাই নাকি আধুনিক ডাক্তারির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বলা হয়, আমাদের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কালটা অন্যান্য অনেক জাতির তুলনায় কম; তাকে বাড়িয়ে তুলতে হবে। তার জন্যই এত বিধি-বন্দোবস্ত। পরমায়ু দীর্ঘতর হলে অবশ্য ভালোই, তবে তা কতটা ভালো তা নিয়ে ঘোর সংশয় আছে। তা ছাড়া এও তো আমাদের মনে রাখতে হয় যে, এই ধরিত্রী থেকে ক্যানসারকে নির্মূল করে দিতে পারলে আমাদের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল তিন থেকে চার বছরের বেশি বাড়বে না। আর তার সঙ্গে যদি অন্যান্য যাবতীয় দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলোকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায় তা হলে তা বাড়বে মোট পনেরো থেকে সতেরো বছর। তাই আত্মম্ভরী লিপ্সা নিয়ে কস্তূরীমৃগের সন্ধানে স্বাস্থ্য-বাজারের কাছে নিজেদের সঁপে দেওয়া আর মেডিকেলাইজেশনকে তোল্লাই দেওয়া আমাদের মানায় না।
সূত্র : এই সময়, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 1/20/2020