জনমানুষ দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত। তাঁরা অস্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগে থাকতে পারেন, কিন্তু আমাদের নির্বোধ, ভানসর্বস্ব পারদর্শীদের মতো ব্যাধি-কাতর না। সকলেই নিজের নিজের জীবন নিজেদের মতো করেই উপভোগ করেন, কোনও নির্মল, নির্দিষ্ট ছক তাঁদের উদ্বেল করে না। এটাই তাঁদের স্বাধীনতা। বিজ্ঞানমনস্কতার নোটবুক আর পেন্সিল হাতে যারা এই স্বাধীনতায় বাদ সাধে তাদেরকে, যে যতই ক্ষুব্ধ হোন, ‘স্বাস্থ্য-পুলিশ’ বলাই সঙ্গত। লোকের ভয়-ভক্তিই তাদের একমাত্র সম্বল। তাই মনে হয়, অমন নজরদারি পুলিশগিরি না-করে বরং জনমানুষের সহযাত্রী হওয়াই ঠিক। তাতে পারস্পরিক আস্থা বাড়ে, সম্পর্কের টানাপোড়েন কমে, পরিতাপও কমে। পারিবারিক চিকিত্সকরা এ-কাজটা করতে পারেন। জীবনের জাহাজে তো কুলগুরুর আসন নেই। তাই দাম্ভিক নেতৃত্বের বদলে রোগীকেই চালকের আসনে বসিয়ে তাঁরা নিজেরা নাবিকের আসনে বসতে পারেন।
সে-কাজটা করতে গেলে দু’টো পূর্বশর্ত থাকে। এক, জনমানুষকে বেবাক মূর্খ বলে না-ভাবা, আর ডাক্তার হিসেবে নিজেকে গুপ্তজ্ঞানের ভাণ্ডারী বলে না-ভাবা। তাতেই হয়তো ডাক্তার তাঁর হারানো সম্মান ফিরে পেতে পারেন। মানুষকে নীতিজ্ঞান শেখানো, সদাচারী হতে শেখানোটা ডাক্তারের কাজ না; বদভ্যাসের পরিণতি থেকে বাঁচানোই তাঁর কাজ। আধুনিক শব্দটার নির্গলিতার্থ যদি হয় মাত্রাবোধ তা হলে স্বাস্থ্য আর ব্যাধিচর্চা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার। কারণ, অমুক ব্যাধিকে চুলের মুঠি ধরে সমাজ থেকে দূর করে দেব, তমুক ব্যাধিকে পায়ের নীচে দাবিয়ে রাখব এই সব মতিবিভ্রমের সঙ্গে আধুনিকতার সম্পর্ক নেই। তাই স্বাস্থ্যরক্ষার মুগুর নিয়ে পথপরিক্রমার ফল শূন্যের চেয়ে তেমন বেশি কিছু হয় না। পরিহারের মন্ত্র শুনতে শুনতে আমাদের কানে তালা লেগে গেছে। এখন আবার বিজ্ঞানীরা তামাক পাতার মধ্যেই ক্যানসার-নিধনের বীজ খুঁজে পেয়েছেন। এ বার তা হলে কী বলা, কাকেই বা বলা? অনেকে ভাবেন, মাঝে-সাঝে চেক-আপ করিয়ে নিলে আর নির্দিষ্ট সময়ান্তরে শরীরটাকে ছাঁকনি দিয়ে দেখে নিলে দোষ কী? দোষ এই যে তাতে উদ্বেগ কমে না, বরং তা চিরস্থায়ী হয়ে যায়। কোন ক্যানসার কত দিনে কত বড়ো হবে তার একটা রাশিবিজ্ঞান-জাত হিসেব থাকতে পারে; কিন্তু তার সঙ্গে নির্দিষ্ট ব্যক্তির সম্পর্ক নেই। আর ছাঁকতে তো হবে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে, রাশিবিজ্ঞানকে না। আবার দোষের সঙ্গে আছে ক্ষতি। ক্ষতি বেশি না লাভ তা নিয়ে ইউরোপ আর আমেরিকায় ১৯৬৩ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত অন্তত ষোলোটি গবেষণা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বরং অনেক বেশি। উদ্বেগ তো আসলে হৃদাঘাত আর ক্যানসার-জনিত মৃত্যুভয় নিয়ে। ২০১২ আর ২০১৪ সালের পর্যালোচনাতেও দেখা গেছে, চেক-আপ আর ছাঁকনি-পর্ব দিয়ে এই সব ব্যাধির বেলায় কাজের কাজ কিছুই হতে চায় না। তা হলে আর মানুষজনকে ভয় দেখানো কেন, মিথ্যে আশ্বাসই বা কেন? কিন্ত্ত মেডিকেলাইজেশন এখন স্বাস্থ্য-বাজারের নিয়ামক। তাকে রাজা বলাই ভালো। রাজা শিকারে বেরিয়েছে। সঙ্গে ঢাকঢোল পেটানোর লোকজনও থাকবে। পারিষদবর্গ পঞ্চমুখে রাজামশায়ের নিশানার বাহবাও দেবে। তবে সেই পারিষদদলে ডাক্তাররাও থাকবেন কি না তা কৌতূহলের বিষয়। রাজার অবান্তর ক্রিয়াশীলতা যে বাজারি ত্রাসের উপকরণ হয়ে যাচ্ছে সেও তো ভাববারই কথা। তাই ডাক্তাররা পেশাজীবী হবেন নাকি মৃগয়াজীবী হবেন তাও তো ভাবতে হয়।
সূত্র : এই সময়, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/18/2020