গালের ছোট ফোঁড়াটা প্রথম চোখে পড়েছিল ছেলের। তিনিই জোর করে মাকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যান। খারাপ কিছু দেখতে পাননি পাড়ার ডাক্তার। ‘সাধারণ একটা ফোঁড়ার’ জন্য মলম দিয়ে ছেড়ে দেন। কিন্তু কমা তো দূরে থাক, ক্রমেই বাড়তে থাকে তা। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে যন্ত্রণা। পরে অন্য এক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতেই, তিনি আর ফেলে রাখেননি। নিদান দেন, “বায়োপসি করাতে হবে।” তাঁর সন্দেহই ঠিক প্রমাণ হয়েছিল। ক্যানসার। স্টেজ ৪।
সংসার-সন্তান নিয়ে সদাব্যস্ত পঞ্চাশের কোঠার মীরা বাগচীর নেশা বলতে ছিল পান। কোনও কোনও দিন খান চারেক বা তারও বেশি সুপুরি দিয়ে জর্দা-পান খেয়ে ফেলতেন। ডাক্তারদের অভিমত, দিনের পর দিন এই পানের নেশাই চুপিসারে ডেকে এনেছে কর্কট রোগ। ঘুণাক্ষরেও টের পাননি মীরাদেবী। ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, মুখের ক্যানসার নিয়ে এ রকম অসংখ্য রোগী ভিড় করছেন হাসপাতালে।
দুপুরের খাওয়াপর্ব মেটার পর বাড়ির গিন্নিদের পানের বাটা সাজিয়ে বসার রেওয়াজ খাস কলকাতায় আজকাল আর নেই বললেই চলে। শহরের অলিতে গলিতে বেশ কিছু পানের দোকান অবশ্য রয়েছে। কিন্তু মফসসল কিংবা গ্রামগঞ্জে দিদিমা-ঠাকুমা-মধ্যবয়সি মহিলাদের মধ্যে এখনও রয়েছে সেই চিরাচরিত রীতি। ডাক্তাররা জানাচ্ছেন, ক্যানসার-বিরোধী প্রচারে বরাবরই সাধারণ মানুষকে সতর্ক করে আসা হয়েছে পানমশলার প্রতিটি উপকরণই ডেকে আনতে পারে মারণ রোগ। কিন্তু মফসসল, পাড়াগাঁয়ে সেই বার্তা পৌঁছেছে কমই।
তবে এটাও ঠিক, তামাক-গুটখা-খৈনি নিয়ে যতটা প্রচার হয়েছে, পান নিয়ে তেমন কিছু হয়নি। সংবাদপত্রেও লেখালেখি হয়েছে খুব কম। ক্যানসার-চিকিৎসকরাই জানাচ্ছেন সেই কথা। বিয়েবাড়ির শেষপাতে থাকা নির্ভেজাল পান-কে তাই কখনওই কেউ সন্দেহের চোখে দেখেননি। তা ছাড়া, গুটখা-খৈনি বিক্রি রাজ্যে নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও, পান-পানমশলা বেচাকেনায় আইনি বিরোধিতা নেই। বরং ভারতীয় সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে রয়েছে ‘পান খায়ে সাঁইয়া হামারো’, ‘খাইকে পান বানারসওয়ালা’-র মতো হিট গানও।
পশ্চিমের দেশগুলোতে মানুষের পান খাওয়ার নেশা নেই। তাই এ বিষয়ে গবেষণার সংখ্যাও বেশ কম। কিন্তু এর মধ্যেই দেশে-বিদেশে যে ক’টি গবেষণা হয়েছে, তাতে বহু ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে পান-সুপুরি-জর্দা ক্যানসারের কারণ। ২০০৯ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার’ (আইএআরসি) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র হয়ে ১০টি দেশের ৩০ জন বিজ্ঞানী রিপোর্ট পেশ করে জানান, জর্দা-সুপুরি দেওয়া পান শুধু দাঁতের গঠন নষ্ট করে না, ক্যানসারেরও কারণ। ‘ল্যানসেট অঙ্কোলজি’ নামে বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়।
সূত্র : সায়ন্তনী ভট্টাচার্য, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ ফেব্রুয়ারি
সর্বশেষ সংশোধন করা : 5/20/2020