আপনার কি কারণে-অকারণে বুক ধড়ফড় করে মাঝেমধ্যেই? আচমকা বেড়ে যায় হৃদস্পন্দন? সঙ্গে শরীরে একটা আজব অস্বস্তিকর অনুভূতি? মিনিটে ৭২-এর বদলে কি নাড়ির গতি কখনও ২০০-২৫০ টপকে যায়? তা হলে সাবধান হয়ে যান এখনই৷ চিকিত্সকরা জানাচ্ছেন, এমন অনুভূতি নিয়ে ঘাবড়ে যাওয়া রোগীর ভিড় হু হু করে বাড়ছে শহরে। চিকিত্সার পরিভাষায়, প্যালপিটিশন। সাধারণত তা প্রাণঘাতী হয় না। তাই সাময়িক অস্বস্তি কেটে গেলে কেউ-ই আর আমল দেয় না। কিন্তু এই প্যালপিটিশন যদি মাত্রাতিরিক্ত হারে বেশি হয়, তখন তা প্রাণসংশয়ও ডেকে আনতে পারে বলে সাবধান করছেন ডাক্তারবাবুরা। ঠিক যেমনটা হতে পারত বছর তিরিশের সরকারি কর্মী মৌমিতা দাসের। অফিস যাওয়ার জন্য বাসে উঠতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আচমকাই বুক ধড়ফড়। একটু পরই বুঝলেন, গতিক সুবিধের নয়। তড়িঘড়ি ট্যাক্সি ধরে কাছাকাছি একটা বেসরকারি হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন বলে অবশ্য সে যাত্রা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। ডাক্তারবাবু অবাক হয়ে দেখেছিলেন, মৌমিতার নাড়ির গতি ৩৪০। যে কোনও সময় অঘটন ঘটে যেতে পারত। কিন্তু ঘটেনি। বিশেষ ম্যাসাজ আর ইঞ্জেকশনের সাহায্যে সে দিন পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন চিকিত্সক। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, যদি আপাতদৃষ্টিতে কোনও কারণ ছাড়াই বার বার এ অনুভূতি ফিরে ফিরে আসে, তা হলে চিকিত্সকের দ্বারস্থ হওয়াটাই বিচক্ষণতা। উল্লেখ্য, সারদা মামলায় ধৃত মদন মিত্রেরও এ সমস্যায় মাঝেমধ্যেই যে উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয় চিকিত্সকদের, তা-ও কবুল করছেন পিজি-র ডাক্তারবাবুরা। চিকিত্সক সুব্রত মৈত্রের কথায়, ‘সাধারণ ভাবে বুক ধড়ফড়ানি কোনও রোগ নয়। রোগের উপসর্গ। কিন্তু হলে বুঝতে হবে, নির্ঘাত কোনও শারীরিক বা মানসিক কারণে কিছু শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন হচ্ছে আপনার শরীরে।’ যদিও, অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সমস্যার নেপথ্যে থাকে জীবনযাত্রায় অহরহ বাড়তে থাকা ‘স্ট্রেস’-এর মাত্রা। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ প্রদীপ সাহার বক্তব্য, ‘বুক ধড়ফড়ের সমস্যা নিয়ে ডাক্তারবাবুর কাছে গেলে, ন্যূনতম কিছু শারীরিক পরীক্ষার পর তিনিই বলে দিতে পারবেন, প্যালপিটিশনের নেপথ্যে রয়েছে হৃদজনিত নাকি মানসিক সমস্যা।’ মৌমিতার মতো বাড়াবাড়ি প্যালপিটিশন (সিভিয়ার ট্যাকিকার্ডিয়া) থাকা মানে অবশ্য নির্ঘাত হার্টের কোনও গঠনগত ত্রুটি। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ আজিজুল হক বলেন, ‘সমস্যা মানসিক হলে সাধারণত স্ট্রেস কমানোর চিকিত্সাতেই সেরে যায়। আর হৃদযন্ত্রের কোনও ত্রুটির কারণে যদি প্যালপিটিশন হয়, সে ক্ষেত্রে তার উত্স খুঁজে বের করা হয় ‘ইলেকট্রো-ফিজিক্যাল স্টাডি’র সাহায্যে। প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার করে কিংবা ক্যাথিটারের মাধ্যমে হৃদযন্ত্রে ক্ষুদ্র তরঙ্গ পাঠিয়ে (অ্যাব্লেশন থেরাপি) সারিয়ে দেওয়া হয় প্যালপিটিশনের উত্সকে।’ কিন্তু চিকিত্সক মহলের আক্ষেপ, এই চিকিত্সা পদ্ধতি রাজ্যের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কোথাও নেই। পিজি-র এক হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, হার্টরেট খুব কম (৫০-এর নীচে) হলে সাধারণত পেসমেকার বসানোর রেওয়াজ। এ চিকিত্সা দীর্ঘ দিনের পুরোনো। সে তুলনায় হার্টরেট খুব বেশি (১৬০-এর ওপর) হলে কী করণীয়, তা নিয়ে চিকিত্সাবিজ্ঞানে তেমন কোনও ধারণা ছিল না দেড় দশক আগেও। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভালভের সমস্যাকেই উত্স বলে ধরা হত। কিন্তু বছর দশেক যাবৎ ইলেকট্রো-ফিজিক্যাল স্টাডির সাহায্যে বোঝা সম্ভব, হৃদযন্ত্রের বিদ্যুৎ উত্পন্ন ও প্রবাহের মধ্যে কোনও গোলযোগ আছে কিনা। গোলযোগ থাকলে, তখনই সংশ্লিষ্ট কোষকে মাইক্রোওয়েভ দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার প্রযুক্তি আজ নাগালে। কিন্তু কলকাতার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে এই পরিষেবার সুযোগ থাকলেও সরকারি হাসপাতালে এখনও তা অধরা।
সূত্র : অনির্বাণ ঘোষ, এই সময়, ১৭ মার্চ ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 5/11/2020