দাতা-গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ যদি ভিন্ন হয়, তা হলে কি কিডনি প্রতিস্থাপন করা যায় যায়? এ শহরেই যায়। যে আধুনিক প্রযুক্তির পোশাকি নাম ‘এবিও-ইনকমপ্যাটিবল ট্র্যান্সপ্ল্যান্টেশন’ বা ‘এবিওআই’। আলিপুর এবং বাইপাসের ধারের বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতালে চালু রয়েছে এ প্রযুক্তি। খরচ অবশ্য কিডনি প্রতিস্থাপনের সাধারণ খরচের উপরে আরও লাখখানেক টাকা।
বিশেষজ্ঞরা যদিও বলছেন, এমনি প্রতিস্থাপনের পর ওষুধপাতির খরচার যা বহর, তা কালে কালে ওই লাখখানেকের ধাক্কাতেই এসে দাঁড়ায়। সমস্যাটা সেখানে নয়। ঘটনা হল, হাতের কাছে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এ প্রযুক্তি সম্পর্কে সচেতনতা কই রাজ্যে! সচেতনতার কথাই যখন উঠল, তখন দু’টো বিপরীতমুখী ঘটনার কথা বলা যাক। যেমন, অভিমন্যু সেনগুপ্ত। ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। ব্লাড গ্রুপ : ও পজিটিভ। সম্প্রতি ডাক্তার জানিয়ে দেন, দু’টি কিডনিই বিকল হয়ে গিয়েছে বছর একুশের যুবকের। বাঁচাতে অবিলম্বে কিডনি প্রতিস্থাপন প্রয়োজন। একমাত্র ছেলেকে নিজেদের একটি করে কিডনি দিয়ে বাঁচাতে চেয়েছিলেন বাবা-মা দু’জনেই। কিন্তু বিধি বাম, দু’জনেরই ব্লাড গ্রুপ ছেলের থেকে আলাদা। সুতরাং, হন্যে হয়ে ডোনারের খোঁজ। এ বার যাওয়া যাক দিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালে। মাসখানেক আগে অভিমন্যুর মতোই পরিস্থিতি হয়েছিল নিশপাল সিংয়ের পরিবারের। তাঁকে কিন্তু ডোনার খোঁজার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়নি। কারণ তাঁর স্ত্রী পূজাই নিজের কিডনি দিতে পেরেছিলেন ৪৮ বছরের এই ব্যবসায়ীকে। অথচ, নিশপাল ও তাঁর স্ত্রীর ব্লাড গ্রুপও কিন্তু ছিল আলাদাই। তা হলে প্রতিস্থাপন হল কী করে? সৌজন্যে, ‘এবিওআই’।
এ শহরের চিকিত্সকরা বলছেন, এখানেও এই প্রযুক্তি এখন ঘোরতর বাস্তব। সাধারণ ভাবে রক্তদান আর কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রাথমিক নিয়ম কিছুটা একই। যেমন, এক ব্লাড গ্রুপের ব্যক্তিই সেই রক্তের গ্রুপধারী অন্য ব্যক্তিকে রক্ত দিতে পারেন (‘ও’ আর ‘এবি’ ছাড়া। কারণ ‘ও’ গ্রুপ সর্বজনদাতা এবং ‘এবি’ গ্রুপের ব্যক্তি হলেন সর্বজনগ্রহীতা)। কিডনির ক্ষেত্রেও নিয়মটা একই, যাকে বলে ‘এবিও কমপ্যাটিবল’ কিডনি প্রতিস্থাপন।
কেন এই নিয়ম? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন নিয়মের কারণ, রক্তে থাকা অ্যান্টিবডি (যেমন, ‘এ’ ব্লাড গ্রুপের ব্যক্তির শরীরে থাকে ‘বি’ অ্যান্টিবডি), যা আদতে বাইরের শত্রুর (ফরেন বডি) বিরুদ্ধে লড়াই তো করেই, রুখে দাঁড়ায় অন্য ব্লাড গ্রুপের অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধেও। অন্য ব্লাড গ্রুপের কিডনি প্রতিস্থাপন করা হলে গ্রহীতার শরীরের এই অ্যান্টিবডির সঙ্গে দাতার রক্তের অ্যান্টিজেনের যুদ্ধ বেঁধে যায়। যে যুদ্ধের ফলে মৃত্যু হওয়াও বিচিত্র নয়। ইউরোলজিস্ট প্রদীপ চক্রবর্তীর কথায়, ‘অন্য রক্ত গ্রুপের এই অ্যান্টিবডিকে রক্ত থেকে বের করার কৌশল জানা না-থাকার জন্যই এই বিপদকে এড়িয়ে যাওয়া হত কিডনি প্রতিস্থাপনের সময়। তাই এবিও কমপ্যাটিবল কিডনি প্রতিস্থাপন করা হত।’ বিশেষজ্ঞদের দাবি, আধুনিক ‘এবিওআই’ পদ্ধতির ব্যবহার অনেকাংশেই কমিয়ে দিতে পারে কিডনির কালোবাজারি। কী ভাবে? প্রদীপবাবুর কথায়, ‘এই পদ্ধতির বহুল ব্যবহার চালু হলে কিডনির দাতার সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। ফলে বাধ্য হয়ে, ঘটিবাটি বিক্রি করে কিডনি কেনার চাহিদাটাও কমবে এক ধাক্কায়। আর তার ফলে কমবে কিডনি বেচা -কেনার ব্যবসাও। তা সত্ত্বেও কেন এই রাজ্যে প্রচার পায়নি এই পদ্ধতি? বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর আসল কারণ সচেতনতার অভাব। রোগীদের পরিজন মনে করেন, এতে প্রাণসংশয় হতে পারে তাঁদের রোগীর। অথচ বিশেষজ্ঞদের দাবি, প্রতিস্থাপনের ১৫ বছর পর পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, ‘এবিওআই ’ রোগীরা নাকি বেশি সুস্থ আছেন এবিও কমপ্যাটিবলদের তুলনায়। তবে বিপক্ষ মতও আছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, ‘এবিওআই পদ্ধতিতে খরচ এবং ঝুঁকি দু’টোই বেশি থাকে।
কী ভাবে সম্ভব এবিও ইনকমপ্যাটিবল কিডনি প্রতিস্থাপন (এবিওআই)?
পদ্ধতি দু’টি।
প্লাজমাফেরেসিস আর গ্লাইকোসর্ব
প্লাজমাফেরেসিস : এই পদ্ধতিতে রক্তের প্লাজমাকে (রক্তরস) রক্তকোষ থেকে আলাদা করা হয়। একটি ছাঁকনির মাধ্যমে বারবার ছেঁকে সেখান থেকে অ্যান্টিবডিগুলো আলাদ করে দেওয়া যায় এই পদ্ধতিতে।
গ্লাইকোসর্ব: একটি যন্ত্র। এটিও অ্যান্টিবডির ছাঁকনিই। তবে তার জন্য রক্ত থেকে প্লাজমা আলাদা করার প্রয়োজন পড়ে না। গ্রহীতার রক্ত ওই যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে এক বার চালান করলেই ছাঁকনির মতো অ্যান্টিবডিগুলি পৃথক করে নেয়।
অ্যান্টিবডি আলাদা করতে পারার জন্যই অন্য রক্তের গ্রুপের কিডনি প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা থাকে না, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র : মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য, এই সময়, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 5/31/2020