এ-ও যেন এক ‘জাদু কি ঝপ্পি’র গল্প। তবে এই জাদুস্পর্শ ‘মুন্নাভাই’-এর সৌজন্যে নয়। উষ্ণ স্পর্শে শহরের একাকী প্রবীণ-প্রবীণাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী হয়ে উঠছে একের পর এক স্বেচ্ছাসেবী উদ্যোগ। শুধু স্বাস্থ্য-চিকিত্সা পরিষেবাই নয়, প্রবাসী সন্তান-সন্ততির সঙ্গে নিয়মিত স্কাইপ-কলিং অথবা শখ মেটাতে নিছক দাবা-তাস খেলা, আইপডে পছন্দের মিউজিক শোনা -- শহরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পল-অনুপলের শরিক হয়ে ওঠা এই সব সংগঠনের চাহিদা তাই বাড়ছে উত্তরোত্তর। প্রবীণ-প্রবীণাদের সাহায্যে অতি-পরিচিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘হেল্পএজ ইন্ডিয়া’ অথবা কলকাতা পুলিশের উদ্যোগ ‘প্রণাম’-এর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে এই ধরনের হেল্পলাইননির্ভর পরিষেবাকে তাই আশ্রয় করছেন শহরের সিনিয়র সিটিজেনরা।
যেমন ‘দীপ প্রবীণ পরিষেবা’। ২০১৩-র এপ্রিলে প্রতিষ্ঠিত এই সংস্থা মূলত প্রবাসী সন্তান-সন্ততির নগরবাসী মা-বাবাদের বিভিন্ন পরিষেবা প্রদান করে। ২৪X৭ হেল্পলাইনের মাধ্যমে এই সংস্থার পঞ্চাশ ‘সহায়ক’ স্বাস্থ্য থেকে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পরিষেবা, একনিষ্ঠ ভাবে দিয়ে চলেছেন সদস্য-সদস্যাদের। সংস্থার তরফে শীর্ষা গুহ বলেন, ‘শুধু স্বাস্থ্য পরিষেবাই নয়, একাকী বয়স্কদের সব থেকে বেশি প্রয়োজন সঙ্গ। স্মার্টফোন-ল্যাপটপ ব্যবহার থেকে শুরু করে প্রবাসী সন্তান-সন্ততির সঙ্গে ই-মেল, স্কাইপ-কলিংয়ে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা -- সব ধরনের সহযোগিতাই দিয়ে থাকেন আমাদের ‘সহায়ক’রা।’ তাই মাসের নির্দিষ্ট তারিখ পেনশন তোলা, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, মন্দির , আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়া অথবা শহরের মধ্যে এ দিকে -ও দিকে যাওয়া-আসা, ‘দীপ প্রবীণ পরিষেবা’র সদস্য-সদস্যাকে ভাবতে হয় না কিছুই। আমেরিকার একটি শিক্ষা সংক্রান্ত কনসালট্যান্সি সংস্থার শাখা হিসেবেই প্রতিনিয়ত কাজ করছে এই সংস্থা। তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই স্বাস্থ্য-চিকিত্সা পরিষেবা। শহরের একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাহায্যে দেওয়া হয় এই পরিষেবা। আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা ৭৭ বছরের জয়শ্রী পালের কথায়, ‘নিজেকে এক বারের জন্যও একা অথবা সহায়-সম্বলহীন বলে মনে হয় না ‘দীপ প্রবীণ পরিষেবা’র সহায়কদের সৌজন্যে।’ ‘দীপ প্রবীণ পরিষেবা’র মতোই স্বাস্থ্য-চিকিত্সা পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে আরও একটি সংগঠন ‘রোড ফর হেলথ’। শুধু বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমের চিকিত্সকদের সঙ্গে সদস্য-সদস্যার যোগাযোগই নয়, ওষুধ খাওয়ার জন্য বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে নির্দিষ্ট সময় ‘রিমাইন্ডার’-এর ব্যবস্থাও রয়েছে এই সংস্থার। ‘রোড ফর হেলথ’-এর সূত্র ধরেই ‘ডায়ালিসিস অন হুইলস’ নামে এ দেশে এক অভিনব পরিষেবার সূচনা হয়েছে। অভিজ্ঞ ডায়ালিসিস টেকনিশিয়ান ও চিকিত্সকের সাহায্যে ‘ডায়ালিসিস অন হুইলস’ নামে অত্যাধুনিক অ্যাম্বুল্যান্সে তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ ডায়ালিসিস প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যায়। রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে ওই অ্যাম্বুল্যান্সে যে ডায়ালিসিস চেয়ারটি রয়েছে, তা কাজ করে হুবহু ডায়ালিসিস বেড-এর মতোই। প্রয়োজনীয় ডায়ালিসিস মেশিন, রিক্লাইনার , পাওয়ার ব্যাকআপ -- কী নেই সে অ্যাম্বুল্যান্সে! যে কেউ সংস্থার কাস্টমার কেয়ার নম্বরে একটিমাত্র কল করলেই তাঁর সাহায্যে ছুটতে শুরু করবে ‘ডায়ালিসিস অন হুইলস’। ‘রোড ফর হেলথ’-এর অধিকর্তা বিজয় শর্মা বলেন, ‘কলকাতার পাশাপশি দিল্লিতেও পুরোদস্তুর কাজ চলে আমাদের। বিক্ষিপ্ত ভাবে হলেও সম্প্রতি বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে পরিষেবা দেওয়ার কাজ।’ বৃদ্ধাশ্রমই যে নিঃসঙ্গ পিতামাতার একমাত্র ঠিকানা নয়, ‘হেল্পএজ ইন্ডিয়া’র মতো সংস্থা তা প্রমাণ করেছিল অনেক বছর আগেই। এর পর কলকাতা পুলিশের এলাকাভুক্ত প্রবীণ-প্রবীণাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে লালবাজার। সীমিত পরিকাঠামো সত্ত্বেও শুরু হয় ‘প্রণাম’-এর যাত্রা। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সাহায্যের মডেল হিসেবে নগরবাসীর কাছে সফলও হয় এই উদ্যোগ। ‘দীপ প্রবীণ পরিষেবা’ অথবা ‘রোড ফর হেলথ’-এর জনপ্রিয়তা ও চাহিদা সেই উষ্ণ জাদুস্পর্শের গল্পকে তাই আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথই সুগম করে। সঙ্গী ‘জাদু কি ঝপ্পি ’...।
সূত্র : অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়, এই সময়, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/14/2020