১। ব্যাকটেরিয়া - দ্যা প্রাকৃতিক ম্যাজিশিয়ান
একটা জলাশয়ে যদি এক দলা ময়লা ফেলা হয় তাহলে কিছুদিন পর সেগুলো আর সেখানে থাকে না। প্রাকৃতিক উপায়েই ওগুলো একসময়ে ভ্যানিশ হয়ে যায়। প্রকৃতির এই স্বতঃশুদ্ধকরণ শক্তি আসলে ব্যাকটেরিয়া নামক একটি অনুজীবের উপর নির্ভরশীল। আমরা পয়ঃবর্জ্য কিংবা কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রকৃতির এই উপায়টাকেই বর্জ্য শোধনাগারের সীমিত এলাকায় নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রচন্ডমাত্রায় সক্রিয় করে তুলি।
আমাদের বর্জ্যগুলো আমাদের জন্য অপ্রয়োজনীয় হলেও সেগুলো ব্যাকটেরিয়ার জন্য খাদ্যের উৎস। এই বর্জ্য পদার্থের মৃতকোষগুলো ভেঙ্গে সেখান থেকে ব্যাকটেরিয়া নিজের জন্য শক্তি সংগ্রহ করে এবং বংশ বিস্তার করে। আর মৃতকোষগুলো এতে ভেঙ্গে সরল অনুতে পরিণত হয় -- যা থেকে আবার উদ্ভিদ নিজের প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করতে পারে (পচনের ফলে সার উৎপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া)।
তবে, একটা মৃত কোষ ভেঙ্গে সেখান থেকে ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহের পর এটা ভেঙ্গে যে বিভিন্ন সরল উপাদান তৈরী হয়, সেগুলোর কিছু অংশ কঠিন পদার্থ আকারে পতিত হয় -- যাকে আমরা উর্বর মাটি বা সার মাটি বা জৈব সার বলে থাকতে পারি। এছাড়া কিছু অংশ গ্যাস আকারেও উৎপন্ন হতে পারে। এই গ্যাসগুলোই পচনশীল বস্তু থেকে আসা গন্ধের কারণ।
২। সাইড ডিশ: খাদ্য জালিকা ও ব্যাকটেরিয়া
একটা খাদ্য শৃঙ্খলের সম্পুর্নকরণ বা শক্তি চক্রের শেষ ধাপ এই ব্যাকটেরিয়া সম্পন্ন করে। খাদ্য শিকলে প্রথম পর্যায়ে সূর্যালোকের শক্তি এবং সরল উপাদান ব্যবহার করে উদ্ভিদ তার নিজস্ব কোষ, পাতা, ফল, ফুল ইত্যাদি উৎপন্ন করে -- এখানে কিছু শক্তি সঞ্চিত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে তৃণভোজীরা সেই তৃণ বা উদ্ভিদ ভোজন করে নিজেদের শরীর বা মাংস গঠন করে। এভাবে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন পর্যায়ের মাংসাসীগণ এগুলোকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে ও জটিলতর কোষ গঠন করে। মূল খাদ্য নির্ভরশীলতার ব্যাপারটা এ্যাত সরল না, এটাকে সেজন্য খাদ্য শৃঙ্খল না বলে খাদ্য জালিকা বলা হয়ে থাকে।
চিত্র: খাদ্য শৃঙ্খল এবং খাদ্য জালিকা
খাদ্য শৃঙ্খল বা জালিকাতে শক্তির চক্রটা দেখানো হয় না। সর্বনিম্ন স্তরে মৌলিক উপাদান থাকে, আর সর্বশেষ স্তরে সর্বোচ্চ স্তরের খাদক থাকে। প্রতিটা স্তরের উপাদানের স্বাভাবিক মৃত্যূ হলে সেই মৃতদেহ থেকে পরবর্তীতে আবার আরেকটা শৃঙ্খল বা জালিকা তৈরী হওয়ার জন্য কাঁচামাল বা মূল উপাদান তৈরী করে এই ব্যাকটেরিয়া। ব্যাকটেরিয়া নিজের বংশ বৃদ্ধির জন্য এই কাজ করলেও এটা সম্পুর্ন বাস্তুতন্ত্রের জন্য একটা অসাধারণ কাজ। শেষ ধাপে মৃতদেহ প্রসেসিং করে মূল উপাদানে ফেরত না দিলে পৃথিবীটা একটা মৃতদেহের আস্তরণ ছাড়া আর কিছুই হত না -- সম্পুর্ন উপাদান ব্যবহার শেষ হওয়ার পর আর নতুন জীবনও শুরু হত না।
৩। সাইড ডিশ: পারস্পরিক নির্ভরশীলতায় ব্যাকটেরিয়া এবং শ্যাওলা
ব্যাকটেরিয়া দেখা না গেলেও এরা এলিয়েন নয়। অন্য প্রাণীদের সাথেও এদের সু-সম্পর্ক থাকতে পারে। যেমন: জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্রে ব্যাকটেরিয়া আর শ্যাওলা (algae)র মধ্যে একটা দারুন পারস্পরিক উপকারী সম্পর্ক বিদ্যমান। এই ধরণের পিঠ চুলকা-চুলকি সম্পর্ককে ইংরেজিতে Symbiotic relation বলে।
বাস্তুতন্ত্রতে আরো দুই ধরণের মৌলিক সম্পর্ক আছে:
শিকারী - শিকার সম্পর্ক: অনেকটা বাঘ-ছাগল সম্পর্কে একদল মারে আর আরেকদল মরে (খাদ্য শৃঙ্খলে দেখেন)
প্রতিযোগীতামূলক সম্পর্ক: এই সম্পর্কে একই রিসোর্সের জন্য ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীরা কামড়া-কামড়ি করে। (ঘাসের জন্য গরু-ছাগলে কম্পিটিশন টাইপের আর কি!)
৪। ব্যাকটেরিয়া না থাকলে?
ব্যাকটেরিয়া না থাকলে মৃতদেহ পঁচতো না। এটা আমরা নিয়মিত দেখে থাকি -- অত্যন্ত ঠান্ডায় ব্যাকটেরিয়া হয় মারা যায় কিংবা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় বলেই ফ্রিজের ভেতরে খাদ্য পঁচে না। পাহাড়ে তুষারের নিচে চাপা পড়া লাশও অবিকৃত থাকে যুগের পর যুগ। এছাড়া মাটিতে লবাণাক্ততা বা অন্য কোন উপাদানের উপস্থিতিতে ব্যাকটেরিয়া বেঁচে থাকা অসম্ভব হলে সেখানে চাপা পড়া লাশ পঁচে না -- আবহাওয়ার কারণে সেগুলো শুকিয়ে শুটকির মত হয়ে যায় (চীনে প্রাপ্ত মমি)। ব্যাকটেরিয়ার জন্য বিষাক্ত কোনো উপাদান থাকলে সেখানে ব্যাকটেরিয়া বাঁচতে পারবে না -- জিনিষও পঁচবে না: যেমন ফর্মালিন; তবে ফর্মালিন মানবদেহের জন্যও অত্যন্ত ক্ষতিকারক - তাই বর্জনীয়।
৫। কিন্তু .... ....
এ্যাত উপকারী ব্যাকটেরিয়া, কিন্তু সমস্যা একটা রয়ে গেছে। সেটা হল ব্যাকটেরিয়া মৃতদেহ ভেঙ্গে যখন নিজের (এবং উদ্ভিদের) খাদ্য জোগায়, তখন প্রচুর অক্সিজেন ব্যবহার করে। আর তাদের খাদ্য (আমাদের ময়লা বর্জ্য) পেলে তা ব্যবহার করে খুব দ্রুত বংশ বিস্তার করে পঁচানোর কাজটা আরো মহা সমারোহে শুরু করে দেয়। ফলে এই মৃতদেহ পঁচানোর কাজটা জলাশয়ে হয়ে থাকলে জলতে দ্রবীভূত অক্সিজেন খুব দ্রুত শেষ করে ফেলতে পারে কিংবা মারাত্নক রকম কমিয়ে ফেলতে পারে। ফলশ্রুতিতে জলর অক্সিজেনের অন্য ব্যবহারকারীগণ জীবনের হুমকীতে পড়ে। যেমন মাছ ফুলকা দিয়ে তখন অক্সিজেন পায় না -- ফলে ঐ এলাকা থেকে পালিয়ে বাঁচে; আর পালাতে না পারলে মরে যায়। সেই এভারেস্ট জয় করতে গিয়ে উপরে অক্সিজেন স্বল্পতায় পড়লে যেমন আকুপাকু করে মানুষ মারা পড়বে, একই ভাবে ব্যাকটেরিয়ার ভোজন উৎসবের অক্সিজেনের প্রচুর খরচের জন্যই কোনো জলাশয়ে ময়লা ফেললে সেখানকার মাছ এবং অন্যান্য প্রাণী মরে ভেসে ওঠে। শহরের আশেপাশের নদী ও লেকগুলো এজন্য বর্জ্য ফেললে হুমকীতে থাকে। এতে পুরা নদীর জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
এখানে উল্লেখ্য যে, জলতে অক্সিজেন কমে গেলে বাতাস থেকে ক্রমাগত একটা নির্দিষ্ট হারে অক্সিজেন জলতে মিশে ঠিকই, কিন্তু ব্যাকটেরিয়া সেই অক্সিজেনও হামলে নিয়ে সটকে পড়ে।
৬। তাহলে উপায়?
ব্যাকটেরিয়া মৃতদেহ ভেঙ্গে ফেলে উপকার করলেও স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এই অতি উপকার আমাদের সহ্য হয় না। তাই বর্জ্য বিশেষত পয়ঃবর্জ্য জলতে ফেলার আগে সেটা থেকে ব্যাকটেরিয়ার খাদ্য উপযোগী উপাদান শেষ করে ফেলতে হবে। আর হ্যাঁ -- এই কাজটাও আমরা পরিশোধনাগারে ব্যাকটেরিয়াকে দিয়েই করিয়ে থাকি। বিভিন্ন বিষক্রিয়ায় যেমন ব্যাকটেরিয়া মারা যেতে পারে, তেমনি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে আদর যত্ন করলে এটা খুব দ্রুত খানা-দানার কাজটা করতে পারে। আমরা পরিশোধনাগারে সেজন্য আসলে ব্যাকটেরিয়া পুষি (পালন করি); যাতে কোনো কারণে ব্যাকটেরিয়া মারা না যায় সেজন্য "জ্বী স্যার", "এটা লাগবে স্যার" করে করে এদের যত্ন নেই। আর এদের মূল কাজ হয় খাওয়া দাওয়া করা (আহ্)। ময়লা জলর সমস্ত খাদ্যবস্তু (মৃত বর্জ্য কোষগুলোই ওদের খাদ্য) ওরা পরিশোধণাগারেই খেয়ে ছিবড়া বানিয়ে ফেলে। ফলে সেই জল পরবর্তী সময়ে জলাশয়ে (নদী, লেক) ছাড়লে সেখানে অক্সিজেন স্বল্পতার হুমকী থাকে না। আর খাদ্য শেষ হয়ে যায় বলে এই জলর সাথে বেরিয়ে আসা ব্যাকটেরিয়াগুলোও বেশিরভাগ মারা যায়, তাই ব্যাকটেরিয়া একাধারে হুমকি এবং সাহায্যকারী।
৭। জৈব পদার্থ পরিশোধন বিদ্যার প্রথম ধাপ: ব্যাকটেরিয়ার জীবনচক্র নিয়ন্ত্রণ
কোন জিনিষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইল সেটার নাড়ি-নক্ষত্র জানা জরুরী। তাহলে ঠিক কোথায় কতটুকু চেস্টা করলে এটাকে বাড়ানো বা কমানো যায় সেটা জানা যায়। মশার জীবনচক্র স্টাডি না করলে এটা যে জলতে ডিম পাড়ে, আর ঐ অবস্থাতেই সবচেয়ে দূর্বল এবং নিয়ন্ত্রণে সুবিধা সেটা জানা যেত না। তাই ব্যাকটেরিয়ার জীবনচক্র নিরীক্ষা করাও জরুরী। নিচের চিত্রে জলতে এক দলা ময়লা (অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়ার খাদ্য) ফেললে এর বংশবৃদ্ধির পর্যায়গুলো দেখানো হয়েছে।
লক্ষ্যনীয় যে খাদ্য পাওয়ার কিছু সময় পরে হুড়মুড় করে বংশ বৃদ্ধির একটা পর্যায় আছে -- কারণ খাদ্যের অভাব নাই। এরপর সেই খাদ্যতে যতজনের বেঁচে থাকা সম্ভব ব্যাকটেরিয়ার জনসংখ্যা সেই পর্যায়ে গেলে জন্ম আর মৃত্যূর সংখ্যা সমান হয়ে যায় ফলে "অপরিবর্তনীয় পর্যায়" সৃষ্টি হয়। এরপরে খাদ্য সব শেষ হয়ে গেলে খাদ্যাভাবে মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে --- ফলে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমে যায়।
সুত্র: বিকাশ পিডিয়া টীম, পশ্চিমবঙ্গ
সর্বশেষ সংশোধন করা : 6/9/2020