পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য নীতিতে নতুন যে উদ্যোগগুলি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বহু আলোচনা হয়েছে, তার অন্যতম ন্যায্য মূল্যের ওষুধ। ২০১২ সালের শেষ থেকে সরকারি হাসপাতালে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান খোলার কাজ শুরু হয়। তার পর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, সত্যিই কি এতে রোগীদের ওষুধের জন্য খরচ কমবে? না কি ছাড় দেওয়ার পরেও ‘জেনেরিক’ ওষুধ যে দামে বিক্রি করে ন্যায্য মূল্যের দোকান, বাইরে অন্য নির্মাতার তৈরি সেই একই ওষুধ পাওয়া যায় অনেক কম দামে? সেই সঙ্গে রয়েছে উদ্বেগ, ন্যায্য মূল্যের দোকানগুলিতে পাওয়া ওষুধগুলি কি নিম্নমানের বলেই কম দামে মিলছে?
এই প্রশ্নগুলির উত্তর পেতে আমার সহকর্মী বেথুন কলেজের শিক্ষক শতরূপা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আমি একটি সমীক্ষা শুরু করি ২০১৩ সালে। তা থেকে প্রাপ্ত ফলের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই নিবন্ধ। তবে তার আগে একটা ‘মুখবন্ধ’ বোধহয় জরুরি। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ রাজ্যের অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সরকারি কোনও নীতির সমালোচনা করলে বিরোধী রাজনৈতিক মতবাদের তকমা মেলে। আবার নীতির সাফল্য তুলে ধরলে শাসক দলের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে আখ্যা জোটে। এই প্রবন্ধে আলোচিত সমস্ত তথ্য ও তত্ত্ব গবেষণালব্ধ— রাজনীতির উপরে উঠে নৈর্ব্যক্তিক আলোচনামাত্র।
জাতীয় নমুনা সমীক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ প্রকাশিত স্বাস্থ্য সমীক্ষায় (২০০৪-২০০৫) দেখা যায়, ভারতে সরকারি হাসপাতালেও ওষুধ, নানা পরীক্ষা, রক্ত, ফিজিয়োথেরাপি, কেমোথেরাপি প্রভৃতির জন্য যথেষ্ট খরচ করতে হয় পকেট থেকে। সেই সঙ্গে আছে হাসপাতালে যাতায়াত, রোগীর আত্মীয়দের থাকা-খাওয়া, আয়া রাখা, ঘুষ দেওয়ার খরচ। এই সবের জন্য পকেট থেকে যে টাকাটা রোগীকে খরচ করতে হয়, এ রাজ্যে তা গড় বাৎসরিক আয়ের ৬.১৫ শতাংশ, যা ভারতের গড়ের (৫.৫) থেকে বেশি। পকেট-খরচের টাকার ৬৬ শতাংশই চলে যায় ওষুধ কিনতে। এ রাজ্যে একটি সমীক্ষায় (২০১০-১১) দেখা যায়, এ রাজ্যের জেলা স্তরের হাসপাতালগুলিতে বিনামূল্যে খুব সামান্য ওষুধই মেলে। রোগীদের যখন প্রশ্ন করা হয় যে সর্বপ্রথম কী উন্নতি করা উচিত, ৯৫ শতাংশই ওষুধের জোগানে উন্নতি দাবি করেন।
এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যবাসীর পকেট-খরচ কমাতে মূলত তিনটি নীতি গ্রহণ করে। ১) সরকারি হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যের ওষুধের জোগান বাড়াতে বরাদ্দ বাড়ানো। ২) সরকারি ডাক্তারদের চাপ দিয়ে ওষুধের ‘জেনেরিক’ নামে প্রেসক্রিপশন লেখা। ৩) জেলা ও রাজ্য স্তরের হাসপাতালে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান খোলা।
এই তৃতীয় উদ্যোগটির সার্থকতা নিয়েই এই সমীক্ষা। এখনও পর্যন্ত রাজ্যে ৯৪টি এমন দোকান খোলা হয়েছে, যেখানে প্রাথমিক ভাবে ১৪২ রকম ওষুধ ‘জেনেরিক’ বা ‘ব্র্যান্ডেড জেনেরিক’ সংস্করণে রাখতে হবে (‘ব্র্যান্ডেড জেনেরিক’ ওষুধে নির্মাতার নাম ও ওষুধের জেনেরিক পরিচয়, দুটোই লেখা থাকে। খুচরো বিক্রেতাদের কাছে এই ধরনের ওষুধ অনেক কম দামে বিক্রি করে নির্মাতা। কারণ নির্মাতারা এই ওষুধগুলির বিজ্ঞাপন বা প্রচারে টাকা ব্যয় করে না। সরকারি ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানে ছাপানো দামের ওপর ৪৮-৭৭ শতাংশ ছাড় পাওয়া যায়)। প্রাথমিক (‘বেসলাইন’) সমীক্ষার পর ২০১৪ সালে মূল সমীক্ষা হয় ৯টি সরকারি হাসপাতালের দু’হাজার রোগীর উপর। তাঁদের অর্ধেক আউটডোরে দেখাতে এসেছিলেন, অর্ধেক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানের বিক্রির নিরিখে খুব ভাল (এসএসকেএম এবং বারাসত জেলা হাসপাতাল), মাঝামাঝি (চিত্তরঞ্জন মেডিক্যাল কলেজ, বাঁকুড়া সম্মিলনী, বালুরঘাট জেলা হাসপাতাল ও কৃষ্ণনগর জেলা হাসপাতাল) এবং খুব খারাপ (বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ ও জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতাল) এবং একটি মহকুমা হাসপাতাল (বারুইপুর)— মোট ৯টি হাসপাতাল নেওয়া হয়। রোগীদের সঙ্গে কথা বলা হয়, তাঁদের সমস্ত প্রেসক্রিপশন ও বেডহেড টিকিট কপি করা হয়। পাশাপাশি, কথা বলা হয় সংশ্লিষ্ট দোকানে ও হাসপাতালের ডাক্তারদের সঙ্গে।
সূত্র : অরিজিতা দত্ত, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 11/14/2019