আমাদের শরীরে কোষের মধ্যে ডিএনএ আছে। ডিএনএ-র মধ্যে আবার পিউরিন নিউক্লিওটাইড থাকে। আবার যে খাদ্যদ্রব্য আমরা খাই, তার থেকেও পিউরিন পাওয়া যায়। এই কোষের মধ্যে থাকা পিউরিনের ভাঙনের ফলে শেষ উৎপাদন বা এন্ড প্রোডাক্ট হিসেবে ইউরিক অ্যাসিড তৈরি হয়। এই ইউরিক অ্যাসিড রক্তে চলে যায় এবং কিডনির মাধ্যমে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে প্রস্রাবের সঙ্গে দেহ থেকে বের হয়ে যায়।
আমাদের প্রত্যেকের শরীরেই ইউরিক অ্যাসিড থাকে, তবে সেটা একটা স্বাভাবিক পরিমাণে। অস্বাভাবিক ব্যাপার তখন হয়, যদি কিডনি থেকে অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড বেরতে না পারে অথবা দেহে বেশি পরিমাণে ইউরিক অ্যাসিড তৈরি শুরু হয়। তখন শুরু সমস্যার। হাঁটুসহ শরীরের বিভিন্ন অস্থি সন্ধি বা জয়েন্টে ইউরিক অ্যাসিড জমা হতে শুরু করে। তখন অস্থি সন্ধি লাল হয়ে ফুলে যায়, ব্যথা-যন্ত্রণা শুরু হয়। এর ফলে আক্রান্ত রোগীর হাঁটতে সমস্যা হতে পারে।
শৈশব ও কৈশোরে রক্তে ইউরিক অ্যাসিড বেশি তৈরি হলে, কিডনি থেকে সেটা সম্পূর্ণ নিষ্কাশিত হয় না। আবার থায়াজাইডের মতো কিছু কিছু ওষুধ প্রয়োগের ফলেও কিডনি থেকে ইউরিক অ্যাসিড বের হওয়াটা আটকে যায়। জিনগত সমস্যার কারণে ছোট বাচ্চাদের অতিরিক্ত ইউরিক অ্যাসিড তৈরিও হতে পারে। বড়দের ক্ষেত্রে খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে ইউরিক অ্যাসিড বাড়তে পারে।
হ্যাঁ। বাড়তে পারে। সচরাচর কিছু সবজি, ডাল খেলে ইউরিক অ্যাসিড বাড়ে এমন বলা হলেও জেনে রাখা দরকার বেশ কিছু প্রাণিজ খাদ্য থেকে কিন্তু অনেক বেশি মাত্রায় ইউরিক অ্যাসিড শরীরে জমা হতে পারে। শহরাঞ্চলে পাঁঠার মাংস, মেটে, চিংড়ি, কাঁকড়া, মাছের ডিম এবং অ্যালকোহল (মূলত বিয়ার) খাওয়ার প্রবণতা বেশি হওয়ার কারণে ইউরিক অ্যাসিড বেশি হতে দেখা যায়।
ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যাওয়াটাকে মেটাবলিক সিনড্রোমের অংশ বলা হয়। তাই উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চমাত্রায় কোলেস্টেরল-ট্রাইগ্লিসারাইড এবং ডায়াবেটিস থাকলে ইউরিক অ্যাসিড বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। তার উপরে যদি নিকট আত্মীয়দের কারও এই সমস্যা বা কিডনি স্টোন, গাউটের সমস্যা থাকে, তাহলে সেই রোগীর ইউরিক অ্যাসিড জনিত সমস্যা অধিক মাত্রায় হতে দেখা যায়।
আবার জীবন শৈলী সংক্রান্ত সমস্যা থেকে ইউরিক অ্যাসিডের আশঙ্কা থাকে। সে জন্য লিপিড প্রোফাইল হাই থাকলে ইউরিক অ্যাসিড টেস্ট করে বহু ক্ষেত্রে ইউরিক অ্যাসিডও বেশি পাওয়া যায়। যদি কারও ক্ষেত্রে রক্তে সুগার, কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইডের হার বেশি থাকলেও ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ কম থাকে, তাহলেও ১/২ বছর অন্তর ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা পরীক্ষা করানো বাঞ্ছনীয়।
রক্তে ইউরিক অ্যাসিড কতটা রয়েছে জানার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা হয়। এর জন্য ১২ ঘণ্টা খালি পেটে পরীক্ষা হয়। আবার স্টোন থাকলেও ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ রক্তে সেই পরিমাণে বেশি না থাকলে, ২৪ ঘণ্টা ইউরিনে ইউরিক অ্যাসিড কতটা বেরচ্ছে সেটা পরীক্ষা করা হয়। বয়সের সঙ্গে ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ অল্প হলেও ক্রমশ বাড়ে। তবে ছোটদেরও যে হয় না, তা কিন্তু নয়। ছোটদের কিছু জন্মগত ত্রুটির কারণে ইউরিক অ্যাসিড, কিডনি স্টোনের সমস্যা হলে তখন জেনেটিক টেস্টিং করা হয়, সেটা শিশু বিশেষজ্ঞরা করে থাকেন।
আবার প্রস্রাব আটকে যাওয়া, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বের হওয়া বা জ্বালা অনুভূত হওয়া জাতীয় উপসর্গ হলে ইউটিআই বা প্রস্রাবে সংক্রমণ হয়েছে কিনা, দেখা হয়। তাছাড়া রোগীর আগে কিডনি স্টোন ছিল কিনা জেনে নেওয়া হয় এবং দেখা হয় রোগীর ব্লাডারে বা ইউরেটারে স্টোন হয়েছে কিনা। সেই মতো এক্স রে, আলট্রাসোনোগ্রাম বা সিটি স্ক্যান করে সেগুলো দেখে নেওয়া হয়।
১. ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে অ্যাকিউট ইউরিক অ্যাসিড আরথারাইটিস হতে পারে। যাকে গাউট বলা হয়। এতে বুড়ো আঙুলের গোড়া লাল হয়ে ফুলে যায়, প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়। এমনকী জ্বর এসে যেতে পারে। হাঁটু, গোড়ালি এবং পায়ের ছোট অস্থিসন্ধি, হাত, কনুই থেকে শুরু করে কবজি, আঙুলের গাঁটে গাঁটে ব্যথা হতে পারে। চাপ পড়লেই ব্যথা বেড়ে যায়। তাই এই সময় বরফ সেঁক এবং পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে বলা হয় ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি।
২. এছাড়াও ইউরেট নেফ্রোপ্যাথি হতে পারে। এতে ইউরিক অ্যাসিড ক্রিস্টালের মতো হয়ে কিডনিতে জমে গিয়ে ইউরিয়া-ক্রিয়েটিনিন বাড়িয়ে দেয়। এর আবার দুটি ধরন। ক্রনিক ইউরেট নেফ্রোপ্যাথি এবং অ্যাকিউট ইউরেট নেফ্রোপ্যাথি।
৩. অ্যাকিউট ইউরেট নেফ্রোপ্যাথি সাধারণত ব্লাড ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা যেতে পারে। তখন সেক্ষেত্রে প্রস্রাবের গতি এবং কিডনির সুস্থতা ঠিক রাখতে ক্যানসারের চিকিৎসা শুরুর আগে ইউরিক অ্যাসিডের পরীক্ষা করে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কমিয়ে রাখার ওষুধ (অ্যালোপিউরিনল জাতীয়) দেওয়া হয়। এর সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে ইনট্রাভেনাস ফ্লুইড দেওয়া হয়।
৪. ইউরিক অ্যাসিড থেকে এছাড়া কিডনিতে স্টোনও হতে পারে। এটা ইউরেটার বা ব্লাডারে নেমে এসে প্রস্রাবের গতিরোধ, রক্তক্ষরণ করতে পারে।
না, আশ্চর্যজনক হলেও সব সময়ে যে উপসর্গ থাকবেই, এমনটা নয়। নিয়মিত চেক-আপে ইউরিক অ্যাসিড বেশি পাওয়া গেলেও এমনও হয় রোগীর জয়েন্টে ব্যথা, স্টোন নেই— অর্থাৎ কোনও উপসর্গ নেই। তখন একে অ্যাসিম্পটোম্যাটিক হাইপার ইউরিসিমিয়া বলা হয়। তখন অ্যালোপিউরিনল ইত্যাদি ওষুধ শুরু করা হয় না। রোগীর লিপিড প্রোফাইল এবং রক্তে সুগার কত জানতে হয়। এমনকী তাঁর ক্যানসার হয়েছে কিনা সেটা জানার জন্য সব ধরনের পরীক্ষা করতে হবে। রোগীর জীবনধারা কেমন, বাইরের জাঙ্ক খাবার, অ্যালকোহল, বিয়ার, রেড মিট বেশি খাচ্ছেন কি না— সব দেখতে হয়।
পুরুষদের ক্ষেত্রে ৭ এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে ৬- সাড়ে ৬ থাকতে হবে। কিন্তু যাঁর আগে গাউট বা কিডনি স্টোন হয়েছে তেমন ক্ষেত্রে ৬-এর মধ্যে থাকতে হবে এবং এর সামান্য উপরে গেলেই চিকিৎসা শুরু করা দরকার। আবার যাঁরা অ্যাসিম্পটোম্যাটিক গ্রুপে পড়ছেন, তাঁদের এই মাত্রা ৮ বা অধিক হলে তারপর চিকিৎসা করা যেতে পারে।
না, ইউরিক অ্যাসিডকে ঠিক জিনগত রোগ বলা যায় না। কারণ জিনগত কারণের সঙ্গে জীবনধারার কারণেও এটা হতে পারে। তাই বাবা-মায়ের থাকলেই যে সন্তানের ইউরিক অ্যাসিড বাড়বে, এমন নয়। আবার এক পরিবারে ভাই-বোনের মধ্যে স্থূলত্ব, উচ্চ রক্তচাপ বা অন্য সমস্যা থাকলে কার গাউট বা কিডনি স্টোন হবে, নাকি হবে না—সেটা আগাম বলা যায় না। বরং বেহিসেবি জীবনধারা, নিয়মিত জাঙ্ক ফুড, রেড মিট, অ্যালকোহল সেবন থেকে এই সমস্যা হতেই পারে।
টমাটো এমনিতে খুবই পুষ্টিকর একটি সবজি। এর নানা গুণ আছে। তবে এটা সত্যি যে এর ফলে ইউরিক অ্যাসিড সামান্য হলেও বাড়ে, তাই বীজ বাদ দিয়ে টমাটোর শাঁসটুকু খান। এছাড়া পালং শাক, মুশুর ডাল, সয়াবিন সবেতেই উচ্চ মাত্রায় প্রোটিন থাকায় কম খেতে বলা হয়। তবে মনে রাখবেন যাবতীয় এই খাদ্য, সবজি বাদ দিয়েও ইউরিক অ্যাসিড হয়তো কমতে পারে মাত্র ০.৫। ফলে নজর দিতে হবে জীবনধারায়। শুধু পালং শাক, মুশুর ডাল বাদ দেওয়াটাই শেষ কথা নয়। কী খাব আর কী বাদ দেব, ভেবেই রোগী চিন্তায় রক্তচাপ বাড়িয়ে ফেলেন।
প্রথমেই বলব পাঁঠার মাংস, গোরু বা শুয়োরের মাংস, মেটে, মাছের ডিম, চিংড়ি (মূলত গলদা, বাগদা), কাঁকড়া— যে কোনও সামুদ্রিক খাবার বাদ দিন খাবারের তালিকা থেকে। চিংড়ি মাছ বাদ দিলে একাধারে সেটা লিপিড প্রোফাইলেও ভালো কাজ দেবে। যাঁরা অ্যালকোহল সেবন করেন (মূলত বিয়ার)— তাঁদের ইউরিক অ্যাসিড বাড়তে পারে।
ছোট মাছ, ডিমের সাদা অংশটা নিশ্চিন্তে খেতে পারেন। কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইডের সমস্যা না থাকলে সপ্তাহে ৬টা ডিম খাওয়া যায়। মাংসে রেড মিট, লিভার বাদ দিয়ে কম চর্বিযুক্ত দেশি মুরগির মাংস খান।
ট্যামসোলোসিন জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয় ইউরেটারিক স্টোন থেকে হওয়া ক্রনিক ব্যথার সমস্যায়।
৬ মিলিমিটারের থেকে ছোট স্টোন হলে সেটা স্বাভাবিকভাবেই বের হয়ে যায়। না হলে ইউরোলজিস্টের মত নিতে বলা হয়। প্রস্রাবে সংক্রমণ থাকলে দেওয়া হয় অ্যান্টিবায়োটিক। গাউট হলে নির্দিষ্ট ওষুধ, অ্যান্টাসিড সহ পেনকিলার দেওয়া হলেও বরফ সেঁক, পা উপরে তুলে রাখতে হবে এবং বিশ্রামের পরামর্শ দেওয়া হয়। এই সময় আগে এইভাবে অস্থিসন্ধির ব্যথা কমিয়ে তারপর অ্যালোপিউরিনল, ফ্যাবুক্সোস্ট্যাট জাতীয় ওষুধ দেওয়া হয়। তবে কিছু ওষুধ থেকে আবার সমস্যা হতে পারে।
অবশ্যই। ইউরিক অ্যাসিডের চিকিৎসায় কোনও রোগীকে কোন ওষুধ দেওয়া যাবে, ভালো করে পরীক্ষা করে তবেই দেওয়া হয়। অ্যালোপিউরিনল থেকে ত্বকে র্যাশ ফোস্কা জাতীয় সমস্যা হতে পারে। এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে বাড়াবাড়ি এতটাই হতে পারে যে রোগী স্টিভেন জনসন সিনড্রোম হয়ে মারাও যেতে পারে। আবার ফ্যাবুক্সোস্ট্যাট থেকে ইসকিমিক হার্ট এবং ইসকিমিক ব্রেন ডিজিজের একটা আশঙ্কা করা হয়। ফলে সবাইকে সব ওষুধ দেওয়া যায় না বলে রোগীর সমস্যা বুঝে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ওষুধ দেন। রোগীর অবস্থা, পরিস্থিতি অনুযায়ী চিকিৎসক চিকিৎসা কী করা হবে, ঠিক করে নেন।
ড: দেবাশিস চট্টোপাধ্যায় এর মতামত
সাক্ষাৎকার: শেরী ঘোষ
সূত্র: বর্তমান থেকে সংকলিত
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/11/2020