অধ্যাপক (ডাঃ) সুকুমার মুখার্জি
এমডি, এফআরসিপি (লন্ডন), এফআরসিপি (এডিনবরা)
এফআইসিপি, এফআইএএমএস, এফএসসিপি
প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মেডিক্যাল কলেজ কলকাতা
সহযোগী
পম্পিতা চক্রবর্তী
পিএইচডি রিসার্চ ফেলো
গেঁটে বাত (রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিস) এক একপ্রকার ক্রনিক প্রদাহজনিত রোগ। এপিডেমিওলজিক্যাল তথ্য অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যার ০.৭৫-১ শতাংশ এই রোগে আক্রান্ত হয়। এই ব্যাধির কারণ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত। যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা শরীরকে নানা সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে, তার অতি সক্রিয়তাই দেহের সুস্থ কোষসমূহকে আক্রমণ করে বসে। রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিসের (সংক্ষেপে আরএ) প্রাথমিক লক্ষ্য হল সিনোভ্যাল কোষ, যা আমাদের হাত, পায়ের গাঁট, কখনও কখনও হাঁটু, কাঁধের সংযোগস্থলকে প্রভাবিত করে।
রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিস আমাদের কাজকর্ম এবং সামাজিক জীবনের উপর প্রভাব ফেলে। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত অনেকেই ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারেন না এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হয়। কাজ করতে না পারাটাই রোগের একেবারে গোড়ার দিকের প্রাথমিক উপসর্গ, বিশেষ করে যারা কায়িক পরিশ্রম করেন। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার দু’বছরের মধ্যেই প্রায় এক তৃতীয়াংশ ব্যক্তি কাজকর্ম বন্ধ করে দেন। এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজকর্ম করতে না পারা লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
এই রোগের কারণ অজানা। এর কারণ সারা বিশ্বে গবেষণার বিষয়। তবে মনে করা হয় যে, বংশ পরম্পরায় জিন ঘটিত কারণে এই রোগ হতে পারে। আবার এ-ও মনে করা হয় যে, কয়েক ধরনের সংক্রমণ বা পরিবেশের কয়েকটি কারণের জন্য স্পর্শকাতর ব্যক্তিদের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই ভুল-পথে-চালিত প্রতিরোধ ব্যবস্থা শরীরের নিজস্ব কোষগুলিকেই আক্রামণ করে বসে এবং ফলে গাঁটে গাঁটে ব্যথা শুরু হয়। পরিবেশের যে কারণগুলি গবেষকরা চিহ্নিত করেছেন তা হল, ধূমপানের অভ্যাস, সিলিকার সংস্পর্শে আসা এবং ক্রনিক দন্ত-সন্নিহিত অসুখ এই রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
কোষ প্রদাহের মাত্রার উপর ভিত্তি করে আরএ-র উপসর্গগুলি আসে আর যায়। যখন কোষ প্রদাহ চলতে থাকে তখন রোগটি সক্রিয় থাকে। আবার যখন কোষ প্রদাহের মাত্রা কমে তখন রোগটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এই অবস্থা আপনা থেকে হতে পারে অথবা চিকিৎসার ফলেও হতে পারে এবং থাকে প্রায় এক সপ্তাহ, কয়েক মাস বা কয়েক বছর। যখন রোগটি আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে উপসর্গগুলি আবার ফিরে আসে। রোগের ফিরে আসা এবং উপসর্গগুলিকে রোগ হঠাৎ বেড়ে যাওয়া বা বিস্তার বলা হয়। এই রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিস হঠাৎ বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া বিভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হয়।
এই রোগের উপসর্গগুলির মধ্যে রয়েছে ক্লান্তি, কাজ করার ইচ্ছাশক্তিতে ঘাটতি, ক্ষুধামান্দ্য, অবসন্নতা, হালকা জ্বর, পেশি এবং সংযোগস্থলগুলিতে ব্যথা। পেশি এবং গাঁটগুলিতে আড়ষ্টতা সাধারণত সকালে অথবা দীর্ঘ সময় কোনও কাজ না করলে লক্ষ করা যায়। সাধারণত একে মর্নিং স্টিফনেস এবং পোস্ট-সেডেন্টারি স্টিফনেস বলা হয়। এই উপসর্গ বাড়লে সাধারণ ভাবে বাত হয়।
রোগ নির্ণয়ের প্রথম ধাপ হল চিকিৎসক ও রোগীর যোগাযোগ। চিকিৎসক রোগের উপসর্গগুলির ইতিহাস পর্যালোচনা করেন এবং সংযোগস্থলগুলির প্রদাহ, নমনীয়তা, ফোলা ভাব এবং বিকৃতি রয়েছে কিনা খতিয়ে দেখেন, বিশেষত আঙুল, কনুইয়ের চামড়ার নীচে বা শরীরের অন্য কোনও অংশে ফোলা রয়েছে কিনা তা দেখেন। কয়েক ধরনের রক্ত পরীক্ষা এবং এক্সরে করতে দেওয়া হয়। রোগে উপসর্গের ধরন, সংযোগস্থলগুলিতে প্রদাহের বিস্তার, রক্ত এবং এক্সরে রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসক রোগ নির্ণয় করেন। এর জন্য চিকিৎসকের কাছে একাধিকবার যাওয়ার প্রয়োজন।
আরএ চিকিৎসায় বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। রোগটির বিভিন্ন পর্যায় এবং তা কতটা মারাত্মক অবস্থায় তার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
যে ওষুধগুলি প্রয়োগ করা হয় নীচে সাধারণ ভাবে তার ধারণা দেওয়া হল ---
বর্তমানে এই রোগ প্রতিরোধের নির্দিষ্ট কোনও ব্যবস্থা নেই। যে হেতু ধূমপান, সিলিকা জাতীয় খনিজ পদার্থের সংস্পর্শ এবং ক্রনিক দন্ত-সন্নিহিত অসুখ এই রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়, তাই এগুলি যতটা সম্ভব এড়ানো উচিত।
প্রথমাবস্থায়, দ্রুত চিকিৎসার দৃষ্টিভঙ্গি রিউম্যাটয়েড আর্থারাটিস রোগীদের পক্ষে ভালো। এই শতাব্দীতে রোগ নিয়ন্ত্রণ করার সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। এই রোগের বিস্তারকে প্রতিরোধ করার পাশাপাশি সামান্য লক্ষণ দেখা গেলে তাকে নির্মূল করতেও সক্রিয় থাকেন চিকিৎসকরা। এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং চিকিৎসক ও রোগীর সমবেত প্রচেষ্টায় কাম্য সুস্থ জীবন জাপন করা যায়।
এই রোগকে সঙ্গে নিয়ে ভালো ভাবে বেঁচে থাকা রোগীর উপর নির্ভর করে। যে রোগী নিজে যত্ন নেন তাঁকে ব্যথা বেশি ভোগায় না এবং ডাক্তারের কাছেও কম যেতে হয়। তাঁরা ভালো ভাবে জীবন উপভোগ করতে পারেন। এর জন্য প্রয়োজন, রোগীর শিক্ষা, স্ব-ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি, সাহায্যকারী গোষ্ঠী যারা রোগীকে তথ্য সরবরাহ করবে যাতে তাঁরা নিজের দায়িত্ব নিজেরা নিতে পারেন।
রোগের গতিপথ নজরে রাখতে নিয়মিত ডাক্তারি পর্যবেক্ষণে থাকার প্রয়োজন। ওষুধপত্র কাজে দিচ্ছে কি না বা ওষুধের কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না এবং সে ক্ষেত্রে চিকিৎসাপদ্ধতির কোনও পরিবর্তন প্রয়োজন কিনা তা নির্ণয় করা দরকার। নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া, রক্ত পরীক্ষা, মূত্র পরীক্ষা, অন্যান্য পরীক্ষা, এক্সরে করা নজরদারির মধ্যে পড়ে।
আর্থারাইটিসের অর্থ হল সংযোগস্থলগুলিতে প্রদাহ। এই প্রদাহের উপসর্গগুলি হল সংযোগস্থলগুলিতে শক্ত ভাব। এ থেকে ব্যথা হতে পারে, ফুলে যায়, স্থানগুলি লাল হয় ও গরমও হয়।
রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিস অন্য আর্থারাইটিসের থেকে আলাদা কারণ, এটি সুষম, শরীরের দু’দিকে সমান ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অন্য ধরনের আর্থারাইটিস সাধারণত শরীরের যে কোনও একটি দিকে আক্রমণ করে।
দেখা গেছে এই আর্থারাইটিস পুরুষের চেয়ে মহিলাদের তিন গুণ বেশি আক্রমণ করে। মহিলাদের ক্ষেত্রে উপসর্গগুলি আরও মারাত্মক হয়। মহিলাদের ক্ষেত্রে আরএ অল্প বয়সেই আক্রমণ করে এবং এই রোগ উপশম হওয়ার ব্যাপারটি পুরুষদের ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়।
বিভিন্ন কারণে এই আর্থারাইটিস হতে পারে। জিনঘটিত কারণে এই আর্থারাইটিস হতে পারে। মহিলারা যে হেতু এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন, তাই এই রোগে হরমোনের ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়। এদের মধ্যে একটি ইস্ট্রোজেন। পরিবেশ এই রোগের একটি অন্যতম কারণ। জীবিকার প্রয়োজনের যারা সিলিকা, কাঠ, অ্যাসবেসটস গুঁড়োর সংস্পর্শে আসেন তাঁদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। ধূমপানের ফলেও এই ধরনের আর্থারাইটিস হতে পারে। মনে করা হয় যে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে আরএ হতে পারে। তবে এ নিয়ে গবেষণা চলছে।
রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিসের ক্ষেত্রে আড়ষ্টতা সাধারণত সকালে অথবা দীর্ঘ সময় কোনও কাজ না করলে লক্ষ করা যায়।
ওষুধ, ব্যায়াম, বিশ্রাম এবং শরীরের সংযোগস্থগুলির সুরক্ষা -- এই সম্মিলিত পদ্ধতিতে এই রোগের চিকিৎসা হয়। কিছু ক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে।
রোগের বিস্তার মানে রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিসের উপসর্গগুলির, যথা ব্যথা, প্রদাহ, লাল হওয়া, গরম হওয়া, হঠাৎ উদয় বা অবস্থা খারাপ হওয়া। এই অবস্থা কমপক্ষে কয়েক দিন বা সপ্তাহ ধরে চলতে পারে।
হ্যাঁ সত্যি। দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহের ফলে কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে কার্টিলেজের ক্ষতি, হাড়ের দুর্বলতা, সংযোগস্থলগুলির বিকৃতি লক্ষ্ করা গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংযোগস্থলগুলির ক্ষতি হতে থাকে।
রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিসে পুরুষদের থেকে মহিলারা ২ থেকে ৩ গুণ বেশি আক্রান্ত হন। ৪০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে, যে কোনও বয়েসেই এই রোগ আক্রমণ করতে পারে। সাধারণত দেখা গেছে পূর্ণবয়স থেকে এই রোগ শুরু হয়। ধূমপান এই রোগের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেয়।
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/30/2020