হেপাটাইটিস বলতে যকৃতের প্রদাহ (ফুলে যাওয়া) বোঝায়। ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণ বা অ্যালকোহলের মত ক্ষতিকারক পদার্থের কারণে ঘটা যকৃতের একটি রোগ। হেপাটাইটিস অল্প কিছু উপসর্গসহ বা কোনো উপসর্গ ছাড়াই ঘটতে পারে। তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে জন্ডিস, এনরেক্সিয়া (ক্ষুধমান্দ্য) ও অসুস্থতাবোধ এর লক্ষণ বা উপসর্গ। দুধরণের হেপাটাইটিস দেখা যায় : তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী। তীব্র হেপাটাইটিস ৬ মাসেরও কম স্থায়ী হয়, অন্য দিকে দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকে। মূলত হেপাটাইটিস ভাইরাসের কারণে এই রোগটির সূত্রপাত, তাছাড়া অ্যালকোহল, নির্দিষ্ট কতগুলো ওষুধ, শিল্প-জৈব দ্রাবক এবং উদ্ভিদের টক্সিক জাতীয় পদার্থের কারণে এই রোগটি ঘটে।
হেপাটাইটিসের ধরণ: হেপাটাইটিসের সাধারণ ধরণগুলোর মধ্যে পড়ে-
হেপাটাইটিস্ এ: হেপাটাইটিস্ এ রোগটির কারণ হল হেপাটাইটিস্ এ ভাইরাস। এটি সবচেয়ে পরিচিত হেপাটাইটিস্ রোগ। এটি সাধারণত সেইসব জায়গায় দেখা যায় যেখানে স্যানিটেশন ও বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা খুব খারাপ। সাধারণত দূষিত খাদ্য ও জল-আহারের মাধ্যমে এর সংক্রমণ ঘটে। এটি স্বল্পমেয়াদি রোগ, যার উপসর্গগুলো সাধারণত তিন মাসের মধ্যে চলে যায়। হেপাটাইটিস এ রোগ হলে ইবুপ্রোফেন জাতীয় পেনকিলার দেওয়া ছাড়া নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। টিকাকরনের মাধ্যমে হেপাটাইটিস এ প্রতিরোধ করা যায়। সংক্রমণের সম্ভাব্য স্থানগুলোতে যেমন; ভারতীয় উপমহাদেশ, আফ্রিকা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, দূরপ্রাচ্য এবং পূর্ব ইউরোপ যাঁরা ভ্রমন করেন তাঁদেরকে হেপাটাইটিস রোগের টিকা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে।
হেপাটাইটিস বি: হেপাটাইটিস্ বি রোগটির কারণ হল হেপাটাইটিস্ বি ভাইরাস। রক্ত ও বীর্য এবং যোনি তরলের মত শরীরের তরলে এটি সংক্রমিত হয়। এটি সাধারণত অসুরক্ষিত যৌন মিলন বা ইনজেকশনের সিরিঞ্জের মাধ্যমে রক্তের মধ্যে সংক্রমিত হয়। ড্রাগ ব্যবহারকারীদের মধ্যে সাধারানত এটি ঘটে। এই রোগটি সাধারণত ভারতবর্ষ ও চীন, মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও উপ-সাহারান আফ্রিকায় হয়ে থাকে। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজে থেকে এই সংক্রমণটিকে প্রতিরোধ করতে পারে ও প্রায় দু-মাসের মধ্যে সংক্রমণমুক্ত হয়ে যায়। তবে, সংক্রমিত ব্যক্তি সংক্রমণের সময় অত্যন্ত অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ে, কিন্তু এটি সাধারণত সুদূরপ্রসারী কোনো ক্ষতি করে না। অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যে অবশ্য এর সংক্রমণ দীর্ঘমেয়াদী হয়, যাকে বলা হয় দীর্ঘমেয়াদী হেপাটাইটিস বি। হেপাটাইটিস বি'র টিকা পাওয়া যায়। ড্রাগ ব্যবহারকারী ও উচ্চ ঝুঁকিসম্পন্ন অঞ্চলে যাঁরা বসবাস করেন তাঁদেরকে এই টিকাকরণের পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে।
হেপাটাইটিস সি: হেপাটাইটিস্ সি রোগটির কারণ হল হেপাটাইটিস্ সি ভাইরাস। এটি সাধারণত রক্তে ও খুব অল্প ক্ষেত্রে সংক্রামিত ব্যক্তির লালা, বীর্য বা যোনি তরলে পাওয়া যায়। এটি সাধারণত যেহেতু রক্তে পাওয়া যায় তাই রক্ত থেকে রক্তের সংস্পর্শে এই রোগটি ছড়ায়। এই রোগের লক্ষণগুলো অনেকটা ফ্লুয়ের মত, তাই অনেকে সাধারণ ফ্লুয়ের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেলেন। অনেক রোগীই নিজে থেকে এই সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারেন ও ভাইরাসমুক্ত হয়ে ওঠেন। আবার অনেকের ক্ষেত্রে ভাইরাসটি দীর্ঘ বেশ কয়েক বছর থেকে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে একে বলা হয় দীর্ঘমেয়াদী হেপাটাইটিস সি। দীর্ঘমেয়াদী হেপাটাইটিস সি'তে যাঁরা ভুগছেন তাঁরা এন্টিভাইরাল কতগুলো ওষুধ নিতে পারেন, তবে সেক্ষেত্রে কতগুলো অপ্রীতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও দিতে পারে। হেপাটাইটিস সি'র নির্দিষ্ট কোন টিকা এখনও পাওয়া যায় না।
অ্যালকোহলজনিত হেপাটাইটিস: প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান করলে এটি দেখা যায়। প্রচুর পরিমাণে মদ্যপানে যকৃত ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে এটি ক্রমশ: হেপাটাইটিস রোগ ডেকে আনে। এটির সাধারণত কোনো উপসর্গ দেখা যায় না, একমাত্র রক্ত পরীক্ষা করলে ধরা পড়ে। অ্যালকোহলজনিত হেপাটাইটিসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি যদি মদ্যপান চালিয়ে যায় তবে তা অত্যন্ত ঝুঁকির হতে পারে। সেক্ষেত্রে , অন্ত্রের কঠিনীভবন (সিরোসিস) ও যকৃতের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
আরো বিভিন্ন ধরণের হেপাটাইটিস
হেপাটাইটিস ডি : হেপাটাইটিস্ ডি রোগটির কারণ হল হেপাটাইটিস্ ডি ভাইরাস। একমাত্র যাঁদের হেপাটাইটিস্ বি হয়েছে তাঁদের মধ্যে এটি দেখা দিতে পারে। একমাত্র হেপাটাইটিস্ বি'র সঙ্গে হেপাটাইটিস্ ডি বাঁচতে পারে।
হেপাটাইটিস্ ই: হেপাটাইটিস্ ই রোগটির কারণ হল হেপাটাইটিস্ ই ভাইরাস। এটি হল স্বল্পস্থায়ী ও এর তীব্রতা কম। এক্ষেত্রে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির সংক্রমণ কম।
অটোইমিউন হেপাটাইটিস: এটি কোনো দীর্ঘমেয়াদী রোগ নয়। এক্ষেত্রে শ্বেত রক্ত কণিকা যকৃতের মধ্যে আক্রমনণ ঘটায়। এরফলে যকৃতের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত সাংঘাতিক কিছু ঘটতে পারে। এই রোগটির সঠিক কারণ এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। এর উপসর্গগুলোর মধ্যে পড়ে ক্লান্তি, তলপেটে ব্যথা, গাঁটের ব্যথা, জন্ডিস (চোখ ও চামড়ায় হলুদাভ বর্ণ) ও সিরোসিস। .স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ (প্রিডনিসোলন ) ক্রমশ: কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ফোলা ভাব কমাতে পারে ও রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে।
হেপাটাইটিস রোগের প্রাথমিক উপসর্গগুলো সাধারণ ফ্লুয়ের মত এবং এগুলোর মধ্যে পড়ে :
যেসমস্ত ভাইরাসের কারণে হেপাটাইটিস রোগটি ঘটে সেগুলো হল : ধরণ- হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি,ই
হেপাটাইটিসের রোগ নির্ণয় প্রাণ-রাসায়নিক (বায়োকেমিক্যাল) মূল্যায়নের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
এ ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন থাকলে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
টিকাকরণ
হেপাটাইটিস এ : বাচ্চাদের (১-১৮ বছর পর্যন্ত) টিকাকরণে থাকছে ২ বা ৩ মাত্রার টিকা। প্রাপ্তবয়স্কদের প্রয়োজন বুস্টার ডোজ (প্রথম টিকার মাত্রার ভিত্তিতে ৬ থেকে ১২ মাস)। টিকার কার্যকারিতা ১৫ থেকে ২০ বছর ও আরো বেশি সময় কার্যকরী হয়।
হেপাটাইটিস বি : নিরাপদ ও কার্যকরী হেপাটাইটিস বি'র টিকা ১৫ বছর বা এরও বেশি সময় পর্যন্ত রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা রাখে। সাম্প্রতিক, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের প্রস্তাব অনুযায়ী ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত যে কেউ এই টিকা নিতে পারেন এবং যে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্করা সংক্রমণের সম্মুখীন বা সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন তাঁরাও টিকা নিতে পারেন। পরিপূর্ণ সুরক্ষার জন্য ছয় থেকে বারো মাস ধরে তিনটে ইঞ্জেকশন নেওয়া প্রয়োজন।
সাধারণভাবে জ্ঞাতব্য বিষয় :
এগুলো শুধুমাত্র নির্দেশমূলক কতগুলো তথ্য। বিশদ জানার জন্য ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
তথ্যসূত্রঃ জাতীয় স্বাস্থ্য প্রবেশদ্বার থেকে সংকলিত
সর্বশেষ সংশোধন করা : 2/14/2020