শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ভোরে এবং রাতে আবর্জনার সঙ্গে পুড়ছে প্লাস্টিকও। আর, সেই পোড়া প্লাস্টিক থেকে ছড়িয়ে পড়ছে বিষাক্ত গ্যাস। যা শরীরে ঢুকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্যানসারের মতো ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাকে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, শহরের আবর্জনা সংগ্রহ করার সময়ে প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকবিহীন আবর্জনা আলাদা করে সংগ্রহ করাটাই নিয়ম। কিন্তু তাঁদের অভিযোগ, কোথাও সেই নিয়ম মানা হয় না। প্লাস্টিক পোড়ানোর দায়ে কারওর কোনও শাস্তি হয় না বলেও অভিযোগ পরিবেশকর্মীদের। টালা থেকে টালিগঞ্জ, বেহালা থেকে কসবা শহরের বিভিন্ন এলাকায় সকালে এবং রাতে ঘুরলে চোখে পড়ে, কে বা কারা স্তূপীকৃত আবর্জনায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছেন। শহরের বড় বড় বাজার, বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং দোকানের সামনে রাতে দেখা যায় এমন দৃশ্য। আরও অভিযোগ, সকালে বিভিন্ন এলাকায় পুরকর্মীরাই আবর্জনায় আগুন ধরিয়ে দেন। আবর্জনা পুড়ে ছাই হওয়ার পরে সেই ছাই তোলা হয় আবর্জনা সংগ্রহের গাড়িতে। কোথাও আবর্জনা সংগ্রহের গাড়িতেই আবর্জনা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে লাগানো হয় আগুন। কখনও আবর্জনা ভর্তি ভ্যাটেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
যদিও কলকাতা পুরসভার জঞ্জাল অপসারণ দফতরের মেয়র পারিষদ দেবব্রত মজুমদারের দাবি, “প্লাস্টিক তো দূরের কথা, আমরা একটা ঘাসও পোড়াই না। কোথাও প্লাস্টিক পোড়ানোর খবর পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ে আমরা সারা বছর সচেতনতা কর্মসূচি করি বিভিন্ন ওয়ার্ডে। বিভিন্ন বাজারে প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো হয়।”
তবে মেয়র পারিষদ যাই বলুন, বাস্তব চিত্র কিন্তু অন্য। রাজ্যের অগ্নি-নির্বাপণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, দমকলের কন্ট্রোল রুমে মাঝেমধ্যেই ভ্যাটে আগুন লাগার খবর আসে।
পরিবেশকর্মীদের আক্ষেপ, আবর্জনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে রায়গঞ্জ, বহরমপুর, শিলিগুড়ির মতো ছোট পুরসভা প্লাস্টিক এবং প্লাস্টিকবিহীন আবর্জনাকে আলাদা করতে পারলেও কলকাতায় সেই পদ্ধতি সফল হয়নি।
প্লাস্টিক পুড়লে কী ক্ষতি হয়? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা বিভাগের বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বেশির ভাগ আবর্জনা সহজে পরিবেশে মেশে। ব্যতিক্রম প্লাস্টিক। প্লাস্টিক পুড়লে সালফার, নাইট্রোজেনজনিত বিভিন্ন গ্যাসের সঙ্গে কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হয়। প্লাস্টিক যে রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি হয়, তা প্রকাশ্যে পুড়লে ‘ডাইঅক্সিনক্স’ নামে একটি বিষাক্ত গ্যাসও তৈরি হয়। যা থেকে ক্যানসারের মতো মারণ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক তড়িৎ রায়চৌধুরী বলেন, “প্লাস্টিক পুড়ে যে সব বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়, তা মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে রক্ত দূষিত হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।”
সম্প্রতি একটি জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর মন্তব্য করেছিলেন, প্লাস্টিক নিয়ে কলকাতা পুরসভা ঘুমিয়ে রয়েছে। ২০০৭ সালে ওই জনস্বার্থ মামলাটি করেছিলেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত।
পরিবেশকর্মীরা জানিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকায় বলা আছে, প্লাস্টিক এবং প্লাস্টিকবিহীন আবর্জনা আলাদা ভাবে সংগ্রহ করতে হবে। তাঁদের মতে, প্লাস্টিক আলাদা করে সংগ্রহ করলে আর্থিক ভাবেও লাভবান হওয়া যায়। প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করে তা থেকে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে বাজারে বিক্রি করা যায়। তা না করে যদি ওই প্লাস্টিক পুড়িয়ে দেওয়া হয়, তা আইন বিরোধী। পরিবেশ আইনবিদ বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “প্লাস্টিক পোড়ানো সম্পূর্ণ বেআইনি। পরিবেশ সুরক্ষা আইন অনুযায়ী এর জন্য অভিযুক্তের এক লক্ষ টাকা জরিমানা এবং পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।” রাজ্যের কোথাও কোনও কাজের জন্য পরিবেশ দূষিত হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের। পর্ষদ কর্তারা জানান, প্লাস্টিক পোড়ানো নিয়ে তাঁদের কাছে এখনও কেউ অভিযোগ করেননি। পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র বলেন, “যে কোনও জায়গাতেই বাতাস বিষাক্ত করা অপরাধ। তাই এই সংক্রান্ত বিষয়ে বা প্লাস্টিক পোড়ানো নিয়ে আমাদের কাছে যদি কেউ নির্দিষ্ট অভিযোগ করেন, তা হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ মার্চ ২০১৫
সর্বশেষ সংশোধন করা : 1/28/2020