সময় নিয়ত পরিবর্তনশীল, এ কথা আমরা সবাই জানি। সময়ের সঙ্গে বদলে যায় সমাজ, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, অর্থনীতি, প্রযুক্তি, জীবনযাপন - এই সব কিছুই।
গত চার দশকে চোখে পড়ার মতো বদল ঘটেছে শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনচর্যাতেও। এক জন মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী হিসাবে এই পরিবর্তনকে বুঝতে চাওয়ার প্রয়াস থেকেই এই লেখার অবতারণা। আরও নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে আমরা এখানে বুঝতে চাইছি, বদলে যাওয়া এই প্রেক্ষাপট শিশুমনে কী প্রভাব ফেলেছে। এখানে শৈশবের সময়সীমাটাকে একটু ছাড় দিয়েছি, আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত ধরে নিচ্ছি শৈশবের স্থায়িত্ব।
এই লেখা কোন সামগ্রিক প্রয়াস নয়, বরং বলা যায় কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনার সমাহার। শুধুমাত্র কিছু প্রবণতাকে চিনতে ও বুঝতে চাওয়ার অভিপ্রায়।
সাতের দশকের শেষ ও আটের দশকের শুরু থেকে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনযাপন যৌথ পারিবারিক গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে একক পরিবারে অভ্যস্ত হতে শুরু করে অনেক বেশি সংখ্যায়। এর মূলে অর্থনৈতিক তাগিদ অবশ্যই একটি বড় ভূমিকা নিয়েছিল। এর পাশাপাশি সামন্ততান্ত্রিক পারিবারিক মূল্যবোধের ভাঙন ও পশ্চিমী ব্যাক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধের ক্রমশ বিকাশও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ক্রমশ ভেঙে পড়েছে যৌথ পরিবারগুলি। স্বামী, স্ত্রী এবং একটি বা দু’টি সন্তানের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একক (unit) পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে ক্রমশ। অবশ্য এই ছোট পরিবারগুলিতে বহু ক্ষেত্রে বয়স্ক বাবা মা-ও থেকেছেন।
এই একক পরিবারগুলিতে বড় হতে থাকা শিশুদের দৃষ্টিতে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে বড়দের আত্মকেন্দ্রিকতার প্রবণতাগুলি।
ক্রমাগত একা হওয়ার, একা ভালো থাকার প্রবণতাই তো বেশি ক’রে চোখে পড়ছে তার চার পাশে। বহু ক্ষেত্রে মা-বাবার কাছ থেকেই সে শিখছে, ‘সবাইকে ক্লাস নোট দেখাবি না’ কিংবা ‘ঝুটঝামেলায় যাওয়ার দরকার নেই, নিজেরটা নিয়ে থাকো’।
সত্যিই এই বাবা-মায়েরা কোনও ‘ঝুটঝামেলায়’ যেতে চান না। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর বিপদ-আপদও তাঁদের কাছে নেহাৎ ঝুটঝামেলা বৈ তো নয়!
পরিবারের বাইরের জগৎ সম্পর্কে নিস্পৃহতা, নির্লিপ্ততা ক্রমশ এক স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। এই নির্লিপ্ততা ও নিস্পৃহতা জন্ম দেয় এই স্থলভূমেও বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট দ্বীপের।
সূত্র : পরিকথা ২০০৭
সর্বশেষ সংশোধন করা : 4/29/2020